নজরুলের ধর্মাধর্ম: কাজীর আধ্যাত্মিক বোধ ও ভাবপ্রকাশের বিশ্লেষণ



অনুপ ঘোষালের নজরুলগীতির ক্যাসেটে ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব’র পরে যে-গানটা আসত, সেই গানটা শোনবার কোনোদিন বিষয়গত ইচ্ছা বোধ করিনি।

আমি যদি আরব হতাম, মদীনারই পথ—
সেই পথে মোর চলে যেতেন নূর-নবী হজরত॥

অথচ প্রথম যখন তার সুরটা বেজে উঠত, অনুপ ঘোষালের কণ্ঠে শোনা যেত ‘আমি যদি আরব হতাম—’ ঐ মুহুর্তে সেই কণ্ঠ রবীন্দ্রনাথের ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুঈন’-এর থেকে অনেক বেশী সৎ শোনাত বা সদিচ্ছ শোনাত— তাই চেষ্টা করেও সেই গানটা ঘুরিয়ে দেওয়া যেত না, মনে হত সেটা করে কোন্ ধর্ম রক্ষা হবে জানি নে কিন্তু সঙ্গীতের সত্যলোকে সেইটা অধর্ম বলে গণ্য হবে। এই জন্য আমি বলি যদি কোনো মজহবি প্রচারকার্য নেহাৎ করতেই হয়, তবে সেটা তলোয়ারের ফলায় বা ভিক্ষান্ন-বাঁধা চালকলায় না হয়ে বরং উদাত্ত গলায় সঙ্গীতের ফরিশ্‌তার পুষ্পক রথে হওয়া উচিত। তাতে আর কিছু না হোক্— গানটা থাকলেও থেকে যেতে পারে, অন্য কোনো প্রোপ্যাগ্যাণ্ডা ইতিহাসে টেঁকে না। আর গানের চেয়ে বড়ো ছাঁক্‌নি আর নেই। গানটা যদি না দাঁড়ায়, তবে সেই অ্যজেণ্ডাতে নিশ্চয়ই কোথাও মিথ্যের ভেজাল ছিল, অমরাবতীর আসরের টিকিটের তার কোনো দফতরি কাগজে ছিল ব্ল্যাকিং— কাব্যলোকের সভা সেই বে-আদবি সইবে না।

    আরেকটা উদাহরণ দিই— দূরদর্শনে চন্দ্রপ্রকাশ দ্বিবেদীর পরিচালনায় ও চিন্ময় মিশনের প্রযোজনায় একটা ধারাবাহিক চলত, নাম ‘উপনিষদ্-গঙ্গা’। ভারত-ইতিহাসের পথে-প্রান্তরে ছড়ানো-ছিটানো গল্পদের একত্রিত করে তার মধ্যে দিয়ে কালতরঙ্গে চির-প্রবহমান ঔপনিষদ্ ভাবধারাকে মূর্ত করে তোলাই ছিল ওঁদের উদ্দেশ্য। একটা প্রকরণে ছিল, বৃদ্ধ সূরদাস চাটাইয়ে বসে শিশু শ্রীকৃষ্ণকে সরল বৈষ্ণব জীবনদর্শন বলছেন— বা কোনো এক সাধারণ মানবশিশুকেই বলছেন, অন্ধ গীতিকারের চক্ষে যার সজ্জা পীতাম্বরে শিখিপুচ্ছে উদ্ভাসিত হয়ে উঠ্‌ছে। এমন সময় তামাম হিন্দুস্থানের রাজনৈতিক অধীশ্বর বাদ্‌শা আকবর সঙ্গীতবিশেষজ্ঞ “মিঞা” তানসেনকে নিয়ে সেখানে এলেন, নিতান্ত এক মুখচোরা বালকের মত মূর্তসম্ভব শ্রীকৃষ্ণ সে-মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলে। বাদ্‌শা চান সূরদাসকে তাঁর বিক্রমাদিত্য-অনুকৃত নবরত্ন সভায় নিয়ে যেতে, এদিকে অন্ধ বাউল যে অন্য এক বাদ্‌শার খিদ্‌মতে আগে থাকতেই বহাল। বাদ্‌শা বললেন, ‘তবে কিছু চান্ আমার কাছে। সূরদাসের সমসময়ে জন্মেও দীন-ই-এলাহির প্রবর্তক ভারতসম্রাট তাঁর পায়ে কোনো দক্ষিণা দেন্‌নি— এমন নিদর্শন থাকলে ইতিহাস ছেড়ে কথা কইবে না।’ তখন সূরদাস নিবেদন করলেন, ‘অভাগাই সে, কুয়া যার কাছে স্থানান্তরিত হয়ে এলেও যে তৃষ্ণার্তই থেকে যায়। যদি নিতান্তই কিছু না দিয়ে যাবেন না, তো মিঞা তানসেনকে অনুরোধ করুন আমার বাদ্‌শার খিদমতে একটি পদ গাইতে।’ মিঞা তানসেন— অর্থাৎ সামাজিক বা কার্যক্ষৈত্রিক অথবা বৈবাহিক সুবিধার জন্য রামতনু মিশ্র ওরফে তানসেন ইতিপূর্বেই ধর্মান্তরিত হয়ে নাম নিয়েছেন মিঞা আতা-আলী খাঁ।

    মিঞা চোখ বুজে গাইলেন— সে পদ ‘সূর-সাগরে’ই আঁজলা ডুবিয়ে তোলা মুক্তো। সপ্তকের ব্যাকরণী কারসাজি বসল বাউল সূরদাসের সরল বাণীর ওপর।

মেরো মন অনত কঁহা সুখ পাবৈ।
কমলনয়নকৌ ছাঁড়ি মহাতম ঔর দেবকৌ ধ্যাবৈ।
পরমগঙ্গকো ছাঁড়ি পিয়াসৌ দুর্মতি কূপ খনাবৈ।

জাহাজের পাখি না-হয় ছেড়েই বা গেল জাহাজ, মাঝমুদ্রে সে জিরাবে কোথায়। ঐ জাহাজেই তাকে ফিরে আসতে হবে। যে মিঞার উদাত্ত সুরারোহণে বর্ষণ নেমে আসত তাথৈ ছন্দে, তাঁর এ-প্রার্থনাও কমলনয়নের দৃষ্টিতে রেজিস্টার্ড হয়নি কে বলতে পারে।

    যারা মুখিয়ে থাকে এই ধরণের আধ্যাত্মিক দূরদর্শন ধারাবাহিকের ওপর নখদন্তসম্বলে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য— যে ভারতবিদ্বেষী অতিবামপন্থীদের সমালোচনার ভয়ে বছরের পর বছর রাজীব গান্ধীর আমলে রামায়ণ আর মহাভারতের প্রজেক্টদুটো পিছিয়ে দিয়েছে দূরদর্শন, আর যাদের কাছে ভ্যালিডিটির প্রত্যাশায় রামায়ণের কাহিনীক্রমের উৎস হিসাবে প্রথম লেখা হয়েছে একটি ননসেন্স উর্দু রামায়ণের নাম আর মহাভারতের চিত্রনাট্য লেখানো হয়েছে রাহি মাসূম রেজাকে দিয়ে— তারা ধরতেই পারল না গোটা দুই ঘ্যানঘেনে সুরে সঙ্গীতের অবতারণা দিয়ে কী দারুণ প্রহসন চলচ্চিত্রের অন্তরাল সরস্বতীস্রোতে বয়ে গেল।

    মূল বক্তব্যে— নজরুলগীতিতে ফিরি। এরপরে যখন গানটা শোনা শুরু করলাম, দেখলাম— এ ত আমার চির-চেনা সেই গান, সেই রাজপথের কথা— ‘যেথা দিনে-রাতে মিলন-রাসে চাঁদ হাসে রে চাঁদের পাশে, / যার পথের ধুলায় ছড়িয়ে আছে শ্রীহরিচন্দন’। কৃষ্ণনামের যমুনাতরঙ্গে-ধোয়া পথের প্রতি কাজী যে গভীর অনুরাগ অনুভব করতেন, এ তো শুধু তারই রূপান্তর। ঐ গানটি লেখার পরেও গোঠের রাখালের প্রাণে কৃষ্ণপ্রেমের যে অরুণিমা চিরন্তন হয়ে রয়ে গেছিল, ‘আমি যদি আরব হতাম’ তার প্রতিফলনেই লেখা।

মা ফাতেমা খেলতো এসে আমার ধূলি ল’য়ে,
আমি পড়তাম তাঁর পায়ে লুটিয়ে ফুলের রেণু হয়ে।

মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্য সম্পর্কে আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত বলতেই হবে, কিন্তু এ-ও ঠিক, আরাধ্যাকে শিশুরূপে পূজা করার প্রথা ভারতবর্ষের বাইরে কোথাও দেখিনি। উত্তরভারতের কিছু শৈলপুত্রী মন্দির, সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকে এনে বাংলাদেশে পপুলারাইজ্ করা স্বামী বিবেকানন্দের ‘কুমারী পূজা’— আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে সুন্দর অথচ সবচেয়ে অব্‌স্‌ক্যোর উদাহরণ যেটিকে বলতে হবে, নবদ্বীপের বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দির‌। রামপ্রসাদের বেড়া বেঁধে দিতে জগজ্জননী এসেছিলেন বালিকার রূপ ধরে— সেই রামপ্রসাদের গানকে কৈলাশেশ্বরীর পায়ের কাছের তুঙ্গশিখরে পৌঁছে দিয়েছেন যেই কাজী, নূর নবীর পয়জরের থেকে তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠবে মা ফাতেমার আড়-না-ভাঙা শিশু-আঙুলের আঁকিবুকি সেই চরণরেখার ধুলার ’পরে— এ আশ্চর্য কী? নজরুলের সব রচনা পরম্পর পড়লে তাঁর ধর্মচেতনা নিয়ে যা অনুমান করা যায়, তার সিনপ্‌সিস্‌ও তিনি নিজেই লিখে গেছেন, ‘আমার মনের দোতারাতে শ্যাম-শ্যামা দু’টি তার, / সেই দোতারায় ঝঙ্কার দেয় ওঙ্কাররব অনিবার।’

কলঙ্কেরই পাল তুলে সই চললেম অকুল-পানে—
নদী কি, সই থাকতে পারে সাগর যখন টানে?
আমি রেখে গেলাম এই গোকুলে কুলের বউ-ঝিরে॥

এই গানটা ইন্দ্রাণী সেনের ক্যাসেটে প্রথমবার শুনে মনে হয়েছিল, ‘হায় রে! এমন গান যদি একটা লিখতে পারতাম, তবে বাকী জীবনে আর কী করে উঠতে পারলাম, তার সার্থকতা নিয়ে ভাবতাম না।’ তারপরে মনে হল, এই কথা স্বঘোষিত ‘কাফির’ কুলত্যাগী ব্ল্যাসফেম নজরুলের নিজেরই কথা নয় তো? ‘আমি রেখে গেলাম এই গোকুলে কুলের বউ-ঝিরে’— সুখে থাক্ তারা ঘরের আগলে, তাদের ধিক্কার আমার সইবে। তোরা ভাব্ কৃষ্ণনামের কলসি বেঁধে গলে আমি ডুবতে বসেছি, আমি তো জানি আমি ডুবছি কালিদহের বৈকুণ্ঠ-হ্রদে। রইল কুল, রইল স্বামী, রইল শাশুড়ি-ননদের গঞ্জনা— মীরা সেই লেগেই রইল তার গিরিধর নাগরের মন্দিরে কীর্ত্তনের আসরে, সর্বধর্মান্পরিত্যজ্যঃ; শ্যামের প্রেমে মজেছি, ‘কমলনয়নকৌ ছাঁড়ি মহাতম ঔর দেবকৌ ধ্যাবৈ?’ সাগর যখন টানে— দুর্মতি কূপ খনাবৈ। দারাহ্ শিকোহ্ও তাঁর ‘মাজ্‌মা-উল্-বাহরাইন’ প্রবন্ধে এরকমই কী একটা বলেছিলেন না? উপনিষদ্ পড়ে তাঁর বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘সমুদ্রে এসে পড়লুম।’ সেই সমুদ্রে বাস্তবিক ডুববার সময়ে দারা নিশ্চয়ই জানতেন, ‘নায়ংহন্তি নহন্যতে’। তবে তাঁর কথা আরেকদিন হবে। তাই মনে হল, হতেও পারে বা। দুজনেরই হৃদিশঙ্খে ওঙ্কার ধ্বনিত হয়েছিল, উপনিষদে হোক্ বা কৃষ্ণপ্রেমে। জ্ঞানে অথবা ভক্তিতে। বোধিতে অথবা স্রেফ ‘আনন্দ’তে।
Nazrul in his film direction debut `Dhruba'

    নজরুলের সেই ঠিক দুইটি তারের শ্যাম-শ্যামায় কখনো সুর তুলে গেছেন সুদূর গ্ৰীক উপমহাদেশের বংশীবাদক অর্ফিউস্, কখনো বলরাম-স্কন্ধে সাম্যবাদের লাঙল— কখনো ‘কৃষ্ণকণ্ঠ, মন্থনবিষ পিয়া ব্যথা-বারিধির’, কখনো আনোয়ার-কামাল পাশা দ্বৈত দ্বৈরথে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গীতে ছিল তাঁর ঝোঁক, ভারতবর্ষের সঙ্গীতে ছিল তাঁর পাণ্ডিত্য, সরস্বতীর ছিলেন তিনি কৃপাপাত্র। স্বভাবতঃ দুঃখবিলাসী নজরুল যেচে পড়েছেন কুমিল্লার আলী আকবর খাঁ-এর পাল্লায়, যেচে গেছেন ফজিতলুন্নিসার কাঁকন-পরা হাতের ধাক্কা খেতে। ‘আনন্দময়ীর আগমনি’তে তিনি স্থির থাকতে পারেননি, ‘বেদনা-শতদলে’ চরণ রাখা মর্ত্যলোকের অশ্রুমতী সরস্বতী তাঁকে স্থির থাকতে দেয়নি। কাজী বারবার বীরের উপাসনায় হয়েছেন উদাত্ত, ক্রন্দসীর মনোবেদনায় হয়েছেন মলিন-মুখ, ধরণীর ধুলিমাখা অমৃতের সন্তানদের মধ্যে গিয়ে পড়েছেন ‘যুগান্তরের খড়্গপাণি’র প্রতিশ্রুত বিপ্লবে‌। কামাল পাশা আর আনোয়ার তাঁদের চরম বৈপরীত্য নিয়ে দু’জনেই তাঁকে মুগ্ধ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের স্নেহ আর রবীন্দ্রানুরাগীদের গালি দুইই তাঁকে বিভূষিত করেছে— আদরিণী শঙ্করতোষিণীর করুণাশ্রু আর ব্যথা-বারিধির মন্থন-বিষ দুইই হয়েছে তাঁর কৃষ্ণকণ্ঠ-লগ্না। নজরুল আপন মনের মাধুরীতে সেই বীররস সিঞ্চিত করেছেন— তাঁর মুসলমানি জগলুল-আমানুল্লাহ্-টিপু-সিরাজুদ্দৌলাকে ঘিরে। মধ্যযুগের বোরখা-ঢাকা অন্ধকার থেকে কাবুল-উপত্যকাকে যিনি মুক্ত করতে চেয়েছিলেন— এবং তাই করতে গিয়ে বুর্জোয়া মোল্লা-শ্রেণী এবং শিনওয়ারী সন্ত্রাসবাদীদের হাতে মরতে মরতে বেঁচেছিলেন ও নির্বাসিত হয়েছিলেন (১৯২৮), সেই আমীর আমান-উল্লার খাঁ’র প্রতি কাজী নজরুল শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন।

তুমি এলে আজ অভিনব বেশে সেই পথ দিয়া, পার্শ্বে যার
স্তূপ হয়ে আছে অখ্যাতি-সহ লাশ আমাদের লাখ-হাজার।
মামুদ, নাদির সাহ, আবদালি, তৈমুর এই পথ বাহি
আসিয়াছে। কেহ চাহিয়াছে খুন, কেহ চাহিয়াছে বাদশাহি।
  
লিখেছেন, ‘বৃথাই গেল সিরাজ টিপু মীরকাসিমের প্রাণ-বলিদান— / চণ্ডি! নিলি যোগমায়া-রূপ, বললে সবাই বিধির বিধান।’ [আনন্দময়ীর আগমনি, সিডিশন-চার্জে বাজেয়াপ্ত কবিতা] নজরুলের ভক্তিরসার্দ্র দৃষ্টিতে সিরাজ-টিপুর ধর্মযুদ্ধে উদ্যত তরবারির হাতল এসে ধরবার কথা ছিল রক্তপাণি খড়্গধারিনীর। সেই স্বভাবতঃ দুঃখবিলাসিতা নিয়ে নজরুলের অবচেতন বারবার ধাবিত হয়েছে মহম্মদের দুঃখিনী কন্যাটির পানে, হাসান-হোসেনের হতাশ্বাসে। বারবার তাঁর আব্রাহামিক্ ব্রিঙ্গিং-আপ্ দৌড়ে গেছে ‘শাতিল্ আরবে’ কারবালার রণপ্রাঙ্গণে ‘উম্মি-আল্-আইমা’র কাছে, ‘উম্ম-আবিহা’ কুমারী শৈলপুত্রীর কাছে। ‘বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতনে’র তলায় হিন্দু নজরুলের ধর্মাধর্ম কোহ্-ই-তুরে কাফিরানায় একাকার হয়ে গেছে॥
 
অনমিত্র বিশ্বাস

Comments

Popular Posts