শুধু এই ভিক্ষাপাত্র আছে part 1
রহে সবে মুখে মুখে চাহি,
কাহারো উত্তর কিছু নাহি।
নির্বাক্ সে সভাঘরে ব্যথিত নগরী-'পরে
বুদ্ধের করুণ আঁখি দুটি
সন্ধ্যাতারাসম রহে ফুটি। [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কথা ও কাহিনী]
Oct 3rd
সে-পথের হাওয়াও কয়লার গুঁড়ো। টোটো-চালক একটা জায়গায় গাড়ি ঘুরিয়ে আমাকে কয়লা খনি দেখাল। আমাদের সামনে দিয়ে অ্যব্রাপ্টলি পাথর ভেঙে গেছে; সামনে প্রকাণ্ড খাদ— তার ঐপ্রান্তে ধূসর আধভাঙা পাহাড়। খাদের বা টিলাগুলোর বিভিন্ন জায়গাতে ধোঁয়া উঠছে, ড্রামের মধ্যে চুল্লী জ্বালিয়েছে কুলি-কামিন আর বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়ে। সভ্যতার ব্যয়ভার বহন করবার জন্য এখানে এরা পৃথিবীর বুক ক্ষত-বিক্ষত করছে। প্রজানুরঞ্জন রাজা রাম দীপালী জ্বালাচ্ছেন নগরের ঘরে ঘরে, এক কোণায় আঁধার মুখে বৈদেহী দেখছে মা-ধরণীকে ক্ষোভে যন্ত্রণায় দ্বিধা হ’তে।
পথে—ধানবাদ থেকে যেতে হলে মুনিডিহ্-বালুডিহ্র একটু পরে, একটা প্যারামিলিটারি ক্যাম্পের কাছে একটা বাজার— মাঝখানে একটা দোকানে থেমে জলের বোতল কিনলাম। যে-মেয়েটি দোকানে বসে ছিল সে ফ্রিজ থেকে বোতলটা বের করে দিয়ে কিছু একটা— সম্ভবতঃ দাম— বলল। আমি বললাম, ‘নর্মাল টেম্পারেচার নেই?’ সে অত্যন্ত সাবলীলভাবে বলল, ‘গাড়ী করে কিছুক্ষণ নিয়ে যাও, এই রোদ্দুরে গরম হয়ে যাবে।’ আমি বললাম, ‘কিত্না বোলা? বিশ?’ অভ্যাসবশতঃ কু্ড়ি টাকার নোট দিলাম। মেয়েটি বলল, ‘না না, পন্ধরা বোলা।’ পাঁচ টাকা সে আমায় ফেরৎ দিল। অন্য ব্র্যাণ্ড, ভাবলাম হবে হয়ত কম দাম। পরে দেখলাম বোতলের গায়ে কুড়ি টাকাই লেখা আছে। কেন কম নিল কে জানে?
ভাটিণ্ডা ফলস্ দামোদরে গিয়ে মেশা একটা ঝর্ণার অনত্যুচ্চ জলপ্রপাত। ফিরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাত্রে খেতে বেরোলাম। যে দোকানটাতে গত দুইদিন খেয়েছি— রুটি আর মটর পনীর। ওরাও জিজ্ঞাসা করল, কেমন গেল ইণ্টারভিউ, ক্র্যাক হলে কবে থেকে জয়েনিং ইত্যাদি। পরেরদিন দুপুরবেলা ট্রেনে গয়া জংশন— তার পরে বৌদ্ধ গয়ায় পৌঁছালাম। মহাবিহারের রাস্তার উল্টোদিকে মহাবোধি সোসাইটির গেস্ট হাউজে একটা ঘরও পাওয়া গেল। ফ্রেশ হয়ে আশেপাশের বিদেশী মন্দিরগুলো দেখতে বেরোলাম।
Oct 4th
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশ্বাসী বৌদ্ধরা ভারতবর্ষের এই পুণ্যতীর্থকে সচল রাখবার দায়িত্ব নিয়েছে বহু বছর ধরে। চীনের একাধিক সঙ্ঘ, ভিয়েৎনাম, জাপানের বহু সংগঠন, থাইল্যাণ্ড, বর্মা— এমনকী চক্ষুলজ্জার খাতিরে, যেই বাংলাদেশে বৌদ্ধরা প্রতিদিন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দ্বারা আহত হচ্ছে, তারাও এখানে এক-একটি মন্দির প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে (বাংলাদেশের মন্দিরটাতে রাষ্ট্রীয় সাহায্য কিছু দেখলাম না, পুরোটাই ওখানকার সম্পন্ন বৌদ্ধদের উদ্যোগ)। এই বিদেশী মন্দিরের পরিকল্পনা নাকি পণ্ডিত নেহরুর ছিল। উদ্যোগটি সারল্যপ্রণোদিত হলে আপত্তি করবার কিছু ছিল না, কিন্তু যেহেতু নেহরু ‘সংস্কৃতিতে মুসলমান, রুচিতে ইংরাজ আর দুর্দৈবে হিন্দু’ তাঁর এই কার্যপ্রণালীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি ভারতের স্বাভাবিক অন্তর্ভুক্তির বিস্মরণই উদ্দেশ্য মনে হয়। বুঝিয়ে বলি। বুদ্ধগয়াতে যে শাক্য রাজপুত্র ধর্মসিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, তাঁর বিমূর্ত্ত ফিলোজফি আর আজকে বহির্বিশ্বে বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিবর্তিত রূপে পার্থক্য অনেক। সেই বিবর্তন স্বাভাবিক; কারণ আপন করে নেবার ঐই পদ্ধতি, স্থান-কাল-পাত্রের ছাঁচে ফেলে। কিন্তু বুদ্ধগয়াতে নেহরু বুদ্ধের উপাসনার চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন সেই বহির্বিশ্বের এলিয়েনেটড বুদ্ধের প্রদর্শনে, যাতে ভারতবাসী হয়ত বা তার আপনার তথাগতর রূপটি ভুলে যাবে— হয়ে উঠবে ‘সংস্কৃতিতে মুসলমান, রুচিতে ইংরাজ আর দুর্দৈবে হিন্দু’! আর বুদ্ধ তার কাছে হয়ে উঠবেন বিদেশী দেবতা। অবশ্য তাতে ঐসব দেশের ধর্মানুরাগীদের সদিচ্ছা বা তাঁদের এই মন্দিরগুলির সৌন্দর্য এতোটুকু কম হয় না। এর মধ্যে চৈনিক মন্দিরগুলির একটা দারুণ এলিগ্যান্স আর জাপানী মন্দিরগুলির শান্তশ্রী লক্ষ্যণীয়। ভুটানের রাজপরিবারের একটা মন্দির আছে, সেও কারুকার্যখচিত। অবশ্য এইসব মন্দিরেই সবচেয়ে বড়ো ন্যুইস্যান্স ভারতীয় ট্যুরিস্টরা— যারা ভক্ত নয়, ট্যুরিস্ট। গেস্ট হাউজের ঘরে সব জিনিসপত্র— এমনকী জুতো আর চলভাষযন্ত্রটিও রেখে, খালি পায়ে রাস্তা পার হয়ে অবশেষে গেলাম মহাবোধি মন্দিরে। ২০১৩তে একটা মুজাহিদিন গ্রুপ মন্দিরে আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করবার ও বেশ কিছু শিল্পবস্তু নষ্ট করবার পর থেকে ওখানে এখন দারুণ কড়াকড়ি— আর হওয়াও উচিত। আমি তো বলি অবিশ্বাসী কিম্বা স্রেফ ট্যুরিস্টদেরও আসা বন্ধ করা উচিত। হয় বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা, নয় ইতিহাস ও শিল্পকলার প্রতি উৎসাহ— কোনো একটা না থাকলে মহাবিহারে ঢুকতে দেবার কোনো মানে হয় না। মক্কার তিন কিলোমিটার ব্যাসার্ধে অ-মুসলিমদের ঢোকা বারণ। নট দ্যাট আমি আদৌ মক্কায় ঢুকতে চাই— কিন্তু বারণটা এখানেও করতে আপত্তি কোথায়?
এই অনুভূতির ব্যাখ্যা করা কঠিন; সমগ্র পৃথিবীর সমবেত প্রার্থনা, বিশ্বাস, অনুরাগ এসে মিলেছে এই ব্রহ্মাবর্তে। অগণিত সন্ন্যাসী— থেরবাদী বা তান্ত্রিক— সহজিয়া বা ধ্যানযোগী— একটা বাচ্চা সন্ন্যাসীকে একজন জাপানী মহিলা একটা টেডি বেয়ার উপহার দেয়াতে সে দারুণ খুশী, তো আর-এক বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনী লাঠি ঠুক্ঠুক্ করে ঢুকে একটা গাছের তলায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন; তাঁর ইচ্ছা, লোকোত্তম বুদ্ধের চরণরেণুর স্পর্শ মাথায় নিয়ে এই পুণ্যস্থানেই ইহলোকের পাট চোকাবেন। গর্ভগৃহে দাঁড়িয়ে ছিলাম যখন, আমার আশেপাশে একটা পরিবার যাদের সকলেরই মুখের ধরণ মোঙ্গোলীয়। বছর ছয়েকের ছেলেটা বিগ্রহের দর্শনমাত্র তার দিদির কাঁধে মুখ লুকাল, বুঝি অতো আবেগ সে ধরে রাখতে পারছে না। তার দিদি তারপরে সেই যে নতজানু হয়েছে প্রার্থনার ভঙ্গিতে, আর ওঠে না। অন্য বোনটির (সেও সাবালিকা) দেখলাম চোখ ছল্ছল্ করছে। বৌদ্ধ তন্ত্রে বলে, গয়া নাকি পৃথিবীর ভরকেন্দ্র, নইলে সদ্য-বোধিলব্ধের চরণভার অন্য কোনো জায়গার মাটি বহন করতে পারত না। এমন পরিবারের হৃদয়রাগে রঞ্জিত হয়ে বোধ করি বৌদ্ধগয়া পৃথিবীর আধ্যাত্মিক ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
অথচ ভারতরাষ্ট্র বুদ্ধগয়ার রক্ষণাবেক্ষণে প্রায় কিছুই করেনি। আমরা এখনো— কমিটির চেয়ারম্যান হিন্দু হবে না বৌদ্ধ হবে— তাই নিয়ে মারামারি করে চলেছি। ঢোকবার মুখে সবচেয়ে যেটা ভালগার লাগল— মহাবোধি মন্দিরেরও ঠিক ঘাড়ের ওপর একটা মসজিদ চড়াও হয়ে বসেছে। এরা স্বাধিকৃত দেশগুলিতে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রকাশ্য উপাসনা বন্ধ করে অকুণ্ঠিতভাবে যেরুসালেম-বারাণসী-মথুরা-বেলুড়-উরুবেলাতে নির্লজ্জের মত দোকান খুলে বসেছে— আর সবই কোনো না কোনো মন্দিরকে বিব্রত করে। রাজনৈতিক ক্ষমতার এতো অশ্লীল প্রদর্শন— ভারতের বুকে অন্ততঃ— অন্য কোনো শাসক করেনি। তবু, মসজিদ যখন পূর্বসূরীরা বানিয়েই ফেলেছে তখন এরা আর কী করবে, এইই ভেবে নেয়া যেত। মহাবোধি মন্দিরে সান্ধ্য প্রার্থনা শুরু হবার অব্যবহিত আগে তারস্বরে সেখানে লাউডস্পীকারে নমাজ চালিয়েছে— বোধিবৃক্ষের সামনে বেদী পর্যন্ত তার বেসুর বিশ্রী শব্দ আসছে। প্রতি আচরণে অন্য ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা এরা নির্বিকারে দেখাতেও পারে বটে! সহনশীলতায় না হোক্ ভদ্রতাতেও বাধে না। কোনো বিশেষ শব্দতরঙ্গের প্রতি এতো বিতৃষ্ণা আমি কখনো বোধ করিনি।
মন্দির প্রাঙ্গণের মুখে যে ফ্রিস্কিং— তার যতো না উদ্দেশ্য মন্দিরের সুরক্ষা নিশ্চিত করা বা সন্দেহজনক সিকিউরিটি থ্রেট ডিভাইস ‘স্ক্রীণ’ করা— তার চেয়ে বড়ো উদ্দেশ্য গুটখার প্যাকেট পাকড়াও করা। লোকাল বিহারীরা তার উপায়ও বের করে বটে! এক বুড়ো কাল কিছুতেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে হাত বের করবে না। এদিকে পুলিশ ছেলেটিও একটিবার তার পকেট না খামচে তাকে ভেতরে ঢুকতে দেবে না। শেষে দেখা গেল তার হাতের মুঠোর মধ্যে গুটখার প্যাকেট। পুলিশ ছেলেটির, বুঝলাম, এরকম অনেক দেখা আছে।
ক্যাম্পাসের ভিতরে প্রধান মহাবোধি মন্দিরের বাইরে এক-সার হিন্দু মন্দির। বোধিবৃক্ষের বেদী ধর্মাশোক বাঁধিয়েছিলেন; আম্বেদকরের মতো ভারতবিদ্বেষীদের ভাষায় যাঁরা ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’— সেই শূঙ্গ রাজারা পাথরের বেড়া বসিয়েছিলেন বোধিবৃক্ষ ও মন্দিরের চারপাশ দিয়ে। এখনো তার অবশেষ সংরক্ষিত আছে সংগ্রহশালায়, আর অনুকরণে নির্মিত পাথরের ঘেরাটোপে পুরো ক্যাম্পাসটি আগেকার পূর্ণরূপে পুনঃসজ্জিত হয়েছে। সাঁচি-সারনাথের রিলিফ-প্যানেল দেখে বোধ হয় সেকালে গাছটাকে ঘিরে মন্দির ছিল, যার জানালা বা স্কাইহোল দিয়ে অশ্বত্থ তার ডালাপালা মেলত। সে-মন্দিরটা আজকে অন্ততঃ নেই। আর-একটা সম্ভাবনা হতে পারে এই যে যে-শিল্পী ঐ রিলিফটি খোদাই করেছিলেন তিনি বোধগয়াতে কোনোদিন আসেননি, গাছের চারপাশে মন্দির কীরকম হতে পারে তাই কল্পনা করে এঁকেছেন। আজকের মন্দিরের গর্ভগৃহে বুদ্ধের মূর্তিটি মন্দিরের পিছনে বোধিবৃক্ষের গা ঘেঁষে। একই বেদী, মধ্যে শুধু দেয়াল। বর্তমান মন্দিরের ইমারতটি— অন্ততঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে, শেষবার বানিয়েছিলেন বাংলার পাল রাজারা। সব কারুকার্য্য টেঁকেনি; ঊনবিংশ শতাব্দীর পরে ইংরাজ, তার যেটুকু উদ্ধার করা গেছে, সযত্নে সংরক্ষণ করেছে। এই মন্দিরে পূজা বন্ধ করেছিল আফগান আক্রমণকারীরা। নালন্দার হত্যালীলার পর থেকে মন্দিরের কর্তৃপক্ষ বা উপাসকরা বোধহয় আর স্বাভাবিক পরিবেশ কোনোদিনই পাননি, বারম্বার আক্রমণে মলিন হয়ে ক্রমশঃ এই মন্দিরের সমাগম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যবদ্বীপ-সুমাত্রা-মালয় দ্বীপপুঞ্জ তাদের হিন্দু-বৌদ্ধ পরিচয় সমসময়ে হারিয়েছে। বাকি স্বাধীন দেশগুলি থেকে তীর্থযাত্রীদের বা পর্যটকদের জন্য আসা ক্রমশঃ বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষে। মহাবোধি মন্দির অব্যবহারের জীর্ণতায় পড়ে রইল। ভাঙা দেউলের দেবতা ছত্রপতির কেতনে তাঁর গৈরিক চীরখণ্ডকে বীরত্বের ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে উঠতে দেখবার অপেক্ষায় রইলেন। ভারতবর্ষের বোধিপথপ্রদীপ তিব্বত ও দূরপ্রাচ্যে গিয়ে ঠাঁই নিল।
ইসলামিক উপনিবেশে বহুকাল পরে সুসভ্যতার ক্ষীণ আলো জ্বেলেছে ইংরাজ শাসক। বিবেকানন্দের পাশ্চাত্যবিজয়ের পরে বুদ্ধগয়াতে এলেন তাঁর সিংহলী সহযাত্রী অঙ্গারিক ধর্মপাল; তিনি দেখলেন মন্দিরের মহন্ত হিন্দু ব্রাহ্মণ পরম যত্নে শিবের পাশাপাশি বিষ্ণুর অবতাররূপে বুদ্ধেরও পূজা করছেন। মূল মন্দির বিপজ্জনকভাবে ভাঙাচোরা, তাই পরিত্যক্ত। ধর্মপালের উদ্যোগে সেই বৌদ্ধগয়ার অধিকার নিয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘাতের সূত্রপাত। প্রশ্নটাই অর্থহীন নয়? মন্দিরের সাড়ম্বর পূজা নিষিদ্ধ করেছিল মুসলমান শাসক; দীপঙ্কর-শারিপুত্র সেই সংকটকালে উপায়ান্তর না পেয়ে বৌদ্ধ ধর্মচর্চার প্রাণকেন্দ্র সরিয়ে নিয়ে গেছিলেন উত্তরে, সে-দেশের সহৃদয় বৌদ্ধ রাজার উদ্যোগে। ভারতবর্ষের বৌদ্ধ-বৈষ্ণব-শাঙ্কর-শৈব-জৈন-শাক্ত সম্প্রদায় সেই অন্ধযুগে ‘কাফের’ পরিচয়ে বিদেশী বিধর্মী আক্রমণকারীর অসিফলকের তলায় বহু শতাব্দী রুদ্ধশ্বাস থেকেছে যুগান্তরের খড়্গপাণির অপেক্ষায়। তারাপীঠের বৌদ্ধ পরিচয় চাপা পড়ে গেছে সময়ের কুজ্ঝটিকায়, জয়দেব গেয়েছেন, ‘নিন্দসিযজ্ঞবিধেরঽহশ্রুতিজাতম্ সদয়হৃদয়দর্শিতপশুঘাতম্ কেশবধৃতবুদ্ধশরীর।’
আজ অঙ্গারিক বিদেশে বিবর্তিত বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে মাপদণ্ড ধরে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ণচ্ছেদ টানতে চাইলে আপত্তি করতেই হবে। মূল মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের সামনে যে সারি-দেয়া প্রিমিটিভলি বিল্ট মন্দিরকক্ষগুলোতে শিব আর বুদ্ধের মূর্তি উপাসিত হয়— মূল মন্দিরের অবর্তমানে যেইখানে এতো শতাব্দী ধরে বুদ্ধের সন্ধ্যারতি অব্যহত ছিল— তার পুজারীই তো বিদেশী বর্বর রাজার শরিয়তি আইনে জিজ্য়া কর জুগিয়ে, প্রাণ-ইজ্জতের ভয়ের বিনিময়ে বুকের রক্ত দিয়ে আগ্লে রেখেছে তথাগতর চরণচিহ্ন এতোদিন ধরে। অঙ্গারিকের মতে সেই ‘বৌদ্ধ’ না-ই হতে পারে, কিন্তু বুদ্ধের উপাসনায় তার অধিকার আর সকলের চেয়ে বেশী সিদ্ধ।
এই মনোভাব অঙ্গারিক ধর্মপালের নিজের দেশে পরবর্তী কয়েক দশকে বীভৎসরূপ ধারণ করেছে। ভারতবর্ষে আমাদের এখন ধ্যেয় হওয়া উচিত হিন্দু ও বৌদ্ধদের পুনরায় এক ছাদের তলায় আনা। আন্তর্জাতিকভাবে বৌদ্ধরা তাদের বিভিন্নতা-সত্ত্বেও কনসোলিডেটেড্— হিন্দু ও বৌদ্ধ এই দুই পরিচয়ের সীমারেখা ভাঙলে তবেই আগ্রাসী বহিঃশক্তির মোকাবিলা করা যাবে। এর দায় বৌদ্ধদের একার নয়। মন্দির প্রাঙ্গণের শুচিতা ও এস্থেটিকস্ সম্বন্ধে বৌদ্ধরা যতোটা সচেতন, হিন্দু উপাসকদের সে-বিষয়ে তাদের থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। আমাদের টুরিস্ট হিসাবে ‘ঘুরতে’ গিয়ে বোধি-বিহারের ব্যবস্থাকে বিব্রত করা বন্ধ করতে হবে। অর্থোপার্জনের হাজারো ধান্ধায় যে অবিশ্বাসী হিন্দুরা সেখানে ঘুরে বেড়ায়— এটা যে-কোনো হিন্দু তীর্থস্থানের বৈশিষ্ট্য— তাদেরকে বিতাড়িত করতে হবে।
গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে বিমুগ্ধ চিত্তে দোরের কাছে একটা বুদ্ধমূর্তিতে কপাল ঠেকালাম, রক্তবাসপরিহিত সন্ন্যাসী মাথায় ফুল রেখে কী যেন মন্ত্র পড়ে দিলেন। বোধিবৃক্ষের রেলিঙে যখন প্রণাম করছি তখন হাত কাঁপছে, পা অবশ। ধূপের ধোঁয়ায় তখনও বৃক্ষবেদী বা বজ্রাসন দেখতে পাইনি। এই সেই বেদী যেখানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধর্মপ্রচারক সত্যের জিগ্স পাজলের শেষ টুকরোটা খুঁজে পেয়েছিলেন। অশোক-কণিষ্ক-ধর্মপালের মতো দিগ্বিজয়ীরা এই মাটিতে পরম বিনম্রতায় মাথা ঠেকিয়ে গেছে। আমি সেইখানে দাঁড়িয়ে আছি! একপাক ঘুরে যখন আবার মন্দিরের সামনে এলাম, তখনো ঘোরের মধ্যে— ‘তথাগত, তব চরণং শরণং করবাণি… তমসো মা জ্যোতির্গময়!’
ক্রমশঃ
Comments
Post a Comment