দুখ-জাগানিয়া

অমনি আমায় কাঁদিয়ে যাবে ভাসিয়ে হাসির বানে—
আঁখির তোমার উছল ভাষা, ও-কথা কানে কানে।
                হাসির সুরের রণনখানি
                মনের মনে বাজল, রাণি,
ভাসিয়ে নিল প্রাপতজলের ফেনিল স্রোতের মত।
হাসির ছোঁয়াচ্ লেগে মম নীরবতা বিব্রত॥

তাথৈ তালে চরণপরশ রাখলে আমার বুকে,
শির্‌শিরিয়ে উঠল কানন— জলদ চাঁদের মুখে।
                চাঁদের মুখের অরুণিমা
                ছাড়াল চরাচরের সীমা,
অমরাবতীর শীতল হাওয়া ধরার আকাশ ব্যেপে
দিত গভীর ঘুমের মত আধোস্বপন লেপে॥

কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ছুঁলে জলের ’পরে
চরণখানি নাচন-দোলায় দীঘল-সরোবরে।
                উঠত দুলে আকাশ চেয়ে
                পা-ধোয়া নীর-উছলে নেয়ে
কমলপাতা অমল হাসির ঊর্মিল সঙ্গীতে।
আকাশ-ভরা বিষণ্ণ ছায় পড়ত, হায়, দীঘিতে॥

কোন্ দ্যুলোকের মেয়ে গো এলে ধরার আঙিনাতে,
আনলে হাসির বন্যা হেথায় ঝির্‌ঝিরে বর্ষাতে।
                সেই হাসিতে পাহাড়-গায়ে
                পড়ল ঢলে নির্দ্বিধায়
পাথর-চাঁই মাথা কুটে তোমার চরণতলে।
পাষাণ-বুকে এমন তৃষা জাগালে কোন্ ছলে?।

অমনি নিঠুর তীব্রতাতে কাঁদিয়ে গেলে, প্রিয়া,
চাতক পাখি যাচ্‌ল মেঘে, গলল রবির হিয়া।
                তবু তোমার নীরব হাসি—
                সাগরজলে ফেনার রাশি—
কোন্ চাঁদেরই অনুরাগে রাঙায় ফাগে গাল।
কোন্ নিশীথের স্বপনচিতে বারিধি বে-সামাল?।

যে দেউলে রাখ্‌লে কমল ও-রাঙা চারু-হাতে
হিঙ্-চুবানো আঙুলগুলোর ভঙ্গিমাসম্পাতে,
                সত্যি কি সেই মূর্তিখানি
                ও-হাত ’পরে রাখল পাণি?
হল বা বৃথা নিবেদনী তোমার প্রেমের দান—
সেই কথাটি ভেবে আমার মুচ্‌ড়ে ওঠে প্রাণ॥

তোমায় আমি ভালবাসি, তাই তোমার ঐ হাসি
মিলালে গো ক্ষণিক আমার ওঠে হৃদয় ত্রাসি’।
                কোন্ মায়াতে বাঁধলে আমায়—
                কোন্ গোপনে কাঁদলে গো, হায়,
তোমার মনের গোপন কাঁদন আমার প্রাণে বাজে।
বাঁশি আমার ধ্বনি’ মরে বে-সুর কাজের মাঝে॥

তোমার সেই নীরব কাঁপন হাসির আড়াল করে
রেখেছ যে, পড়ল ধরা, কী ফাঁকি দেবে মোরে?
                পুব-আকাশের স্নিগ্ধ রবি
                সে উত্তাপে উঠ্‌ল দ্রবি,
সকল আলো আঁধার করে মনের অন্ধকারে।
আকাশ বুঝি আঁধার হল তোমারও ঐ পারে?।

নদীর এপার মরল কেঁদে তোমার অধর ছুঁয়ে,
সেই ছোঁয়া কি কল্পনাতেও ওড়ায় অলক ফুঁ-য়ে?
                মাঝনদীরই ঘূর্ণি জলে
                তলাল কি অতল তলে,
সকল কাঁদন গেল ধুয়ে নদীর পারাবারে?
বইল না কি তোমার মনে মধুর অশ্রুধারে॥

ওপারে হতে ঢেউ এসে, সই, ভেঙেছে এই তীর,
ভাঙা তীরে ঘর বেঁধেছে বে-ঘর মুসাফির।
                তার ছাউনির ভিতের তলে
                ভাঙ্‌ছে মাটি বানের জলে,
ঐ পারে কি মনের কোণে লাগল না তার ঢেউ?
অর্ফিউসের তন্দ্রাসুরে গাইল না আর কেউ?।

ও-পার দেখি দেউল চূড়ায় তোমার বোনা কেতন,
দেউল-দ্বারে তোমার চরণ, সোপান অবচেতন।
                সেই দেউলে বাজলে শাঁখ
                দেয়ালগুলো রয় নির্বাক—
তোমার শ্বাসের পরশ লেগে করে না আন্‌চান,
তোমার ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙে না— এমনি সে নিষ্প্রাণ॥

এপার হ’তে দেখি, ভাবি— এই কি ভবিতব্য?
হে দেবি, কোন্ অযাচিতের হলে সহজলভ্য!
                তোমার পূজা পায়ে ঠেলে
                হারায় মূর্খ অবহেলে,
বিনা পূজায় দেখা পেলে হয় না সে-জন ধন্য।
প্রতিমার ঐ ঐশী রূপে শুধুই কি লাবণ্য?।

তোমার সুরে সুর মিলিয়ে লেখেনি যে-জন পদ্য,
চরাচরের মাধুর্য্যে সে অবোধ গোঁয়ার হদ্দ।
                তার তরে, দেঈ, মর্মতলে
                লাগল আঘাত দরদ-ছলে,
অকরুণের গললে হিমে, অরুণরাগে রাঙ্‌ল আঁখি।
বাঁধল বুঝি শেকলি দিয়ে প্রেমময়ীর হিয়ায় রাখী?।

যে কথাটি কয়েছ রাণি, তাইতে তোমার মন
আমার হৃদয়-আরশিতে ফেলেছে আলোড়ন।
                সেই মরমে কোন মায়াবী
                রাখল এসে দানের দাবী—
সেই দাবীরই তুচ্ছতাতে এত তোমার বাণী
হারিয়ে গেল কোন্ আঁধারে, পাইনি খুঁজে, রাণী॥

যে ক্ষণিকের দেখা মোদের, যে ক্ষণিকের হাসি,
গিলে নেবে প্রতিদিনের গতানুগতিক আসি।
                পরালে মোর নগ্ন শিরে
                হাসির সুরধুনীর তীরে
কত রাজায় ঈর্ষণীয় কোন্ ইন্দ্রের তাজ।
আমার তরে হাসিটুকুই রইল করে সাজ॥

কান্নাটুকু লয়ে বুকে কোন্ বন্ধুর পথে
চললে একা অভিসারে দুর্গমতার ব্রতে।
                কাঁদন কেবল মনে মনে
                দেখেছি, দেঈ, আঁখির কোণে—
কোন্ গরবে কাঁদনখানি রাখলে আড়াল করে?
বুকে আমার বেজেছে তোর বীণার মীড়, ওরে—

আড়াল তোমার কাঁদন আমার ছেয়েছে আকাশ মেঘে,
তোমার বিষণ্ণতার সুরে ঝড় উঠেছে জেগে।
                সেই ফোঁপানি আঁধার ভেদি’
                তোমার বাণী গরব-জেদী
পৌঁছাল কি তোমার কাছে চাঁদের আলোর নায়ে?
হৃদয় আমার কাঁদিয়ে গেল হিমেল শীতের বায়ে॥

অমনি আমায় কাঁদিয়ে গেলে হাসির বানে, রাণি—
রইল শুধু কানন ঘিরে তোমার বিদায়বাণী।
                তোমার বাণী ঝরা পাতে
                হারাল সেই শূন্যতাতে—
তোমারও বুঝি বাজবে বুকে হাল-বেচালা পানি,
কোথায় যেন হারিয়ে গেছে নীরবে অভিমানী॥

Comments

Popular Posts