ব্রজ উপভাষায় চাঁদ বরদাঈ-রচিত পাঁচালীকাব্য ‘পৃথ্বীরাজরাসো’ ও তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে কিছু মন্তব্য

(এই গ্রন্থটি সম্প্রতি একটি হিন্দী ছবির আধার-রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। ছবিটির বিচার করার যোগ্যতা আমার আছে কিনা জানি না, কিন্তু যদি আমার মত শুনতে চান আমি বলব ছবিটা মোটের ওপর বেশ ভালোই। কিন্তু পরিচালক চন্দ্রপ্রকাশ দ্বিবেদীর ইতিহাসনির্ভর আর যা যা কাজ আছে তার প্রত্যেকটিই আমি আগে একাধিকবার ক’রে দেখেছি এবং মনে হয়েছে এর চেয়ে আর্ট হিসাবে অনেক সার্থক। কারণ হিসাবে আমার মনে হয়েছে যে অন্য ক্ষেত্রে দ্বিবেদী-মহাশয় নিজে গ্রন্থ ও তথ্যের ব্যাখ্যা করেছেন, চরিত্রদের গুণ ও দোষ বিবেকের ও বোধের মাপদণ্ডে মেপেছেন। কিন্তু এই বিষয়টি জাতীয়তাবাদী ভাবনার সাথে এতোটাই সম্পৃক্ত যে এখানে কেবল প্রচলিত ধারণার স্রোতে বয়ে যাওয়া ব্যতীত তিনি আর কোনো ট্যা-ফোঁ করেননি। ফলতঃ, তাঁর ‘উপনিষদ্-গঙ্গা’র অধ্যাত্ম আর ‘সুরাজ্য সংহিতা’র নৈতিকতা আর ‘চাণক্যে’র চেতনা আর ‘মৃত্যুঞ্জয়ে’র সংবেদনশীলতা কোনোটাই এই ছবিতে প্রকাশ পায়নি। অন্য কেউ বানালে এই ছবিকেই ধন্য-ধন্য করতাম, কিন্তু শ্রীদ্বিবেদীকে তাঁর এতদিনের কাজের জন্য আমি বড়ো বেশী শ্রদ্ধা করি। বইটি পড়ে আমার কিছু কথা মনে হয়েছে, এ নিয়ে আরো কিছু লেখার বা ছবি আঁকার ইচ্ছা আছে।)

 

 

পৃথ্বীরাজ চৌহান ভারতবর্ষের শেষ ভারতীয় সম্রাট (সম্রাট অর্থে তিনি স্বশাসিত আজমীর প্রদেশের সমান্তরালে দিল্লীনগরীরও শাসক), তাই তাঁর কাহিনী যতটা বিয়োগান্তিক ততটাই অপদার্থতার। নিপুণ শস্ত্রবিদ্যা ও প্রগাঢ় ধর্মচেতনার সাথে এই দুর্দান্ত ক্ষত্রসন্তানটি ছিলেন আদ্যন্ত আয়েশী, রগচটা, মদ্যপ ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ। নইলে অত সহজে তুর্ক দানবেরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করতে পারত না, কনৌজ তাদের সাহায্য করেছে তারও ঐতিহাসিক সত্যতা সন্দেহাতীত নয়; সম্ভতঃ কন্যার সীমন্তশূন্যকারী পিতার ওপর গ্ৰাম্য চারণিকদের বয়ানে স্বাভাবিকভাবেই বর্ষিত হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের আরোপ। মহম্মদ ঘোরীকে শব্দভেদী বাণ দ্বারা হত্যা যেমন পৃথ্বীরাজের দক্ষতার পরিচায়ক তেমন এও সহজপ্রতীত যে এদ্বারা ধর্মরক্ষা হলেও রাজ্যরক্ষা (প্রজারক্ষা) হয় না। বীরপ্রসূ ভারতভূমি তখন কেবল ধর্মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ; বিদেশী বিবেকহীন দস্যুসম্প্রদায়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে তাকে এরপরে ছত্রপতির ছত্রতলে ধর্মকে সহজ করে নিয়ে ব্যক্তিগত ধর্মসিদ্ধির জায়গায় কিঞ্চিৎবক্রপথে মহত্তর রাষ্ট্র-সচেতন কার্যসিদ্ধির দিকে মনযোগ দিতে হবে; কারণ শত্রুর তার অকার্য কিছুই নেই।


১। চাঁদ বরদাঈ প্রত্যক্ষ অভিযোগ ব্যতীত আর সব প্রকারেই পাঠকের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন যে তাঁর পরম বন্ধু (যে বন্ধুর জন্য তিনি পরে প্রাণ অবধি দেবেন) চরম অদূরদর্শিতা ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতার পরিচয় দিয়েছিলেন সংযুক্তা (সংযোগিতা)-হরণের সময়ে কান্যকুব্জের যুদ্ধে। পরম্পর বিদেশী আক্রমণের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর বীর যোদ্ধাদের অর্ধাধিককে কেবল বালকোচিত স্বার্থের অগ্নিতে আহুতি দিয়েছিলেন। চাঁদ হয়ত এই আচরণকে তাঁর আজন্ম সংস্কারের কারণে অন্যায় বলে মনে করেননি, তবে বিরক্ত হয়েছিলেন বিলক্ষণ।

২। চাঁদ বলেছেন, ‘শাবদিন’ ঘোরীকে হত্যা করে পৃথ্বীরাজ আপন মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে তাঁর সুনিপুণ শস্ত্রচালনার শেষ নিদর্শন রেখে গিয়েছিলেন। জৈন ও মুসলমান উভয় ধারার সাহিত্যেই এই শেষ আপাত ‘হ্যাপি এণ্ডিং’-এর কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু চাঁদের লেখার তাৎপর্য ঠিক কতটুকু? কারণ তার আগে পৃথ্বীরাজ উত্তর ভারতের ভবিষ্যৎ অর্ধসহস্রাব্দের অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন; শাবদিন যে ছলের দ্বারা যুদ্ধ জিতেছিল এ অভিযোগ চাঁদের মত পরম শত্রুও করেনি। পৃথ্বীরাজ বৃথা অন্তর্দ্বন্দ্বে নিজের শক্তিক্ষয় করেছিলেন আর প্রেম-বিরহের কুয়াশার প্রলেপ চোখের ওপর এতোদূর প’রে ছিলেন যে তাঁর সেই শৃঙ্গাররসের বানপ্রস্থে রাষ্ট্রের সমুপস্থিত সঙ্কটের কোনো ছায়া রেখাপাত করেনি। দিল্লীর— বা যেকোনো রাজ্যের— রাজার জন্য যা অপরাধের পর্যবসিত। এরপরে অন্ধ পৃথ্বীরাজ ছত্রপতির গরিমা নিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার ব্রত গ্রহণ করেননি— তিনি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার মার্গ বেছে নিয়েছেন। তার অনেক আগেই ক্ষত্রিয় পৃথ্বীরাজের মৃত্যু ঘটে থাকার কথা, ঘোরীকে হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে নিজের উপাস্য অস্ত্রবিদ্যার পসরা নিয়ে সার্কাস দেখাতে নেমেছিল আমূল অন্ধ সংস্কারে আচ্ছন্ন এক যুগবৈশিষ্ট্য; হরিহর-বুক্ক বা ছত্রপতির মত মর্মক্ষত্রিয় না জন্মানো পর্যন্ত ভারতবর্ষের মুক্তির আশা ছিল না। পৃথ্বীরাজ ভারতবর্ষকে যুধিষ্ঠিরের মত খেলার ছলে খুইয়েছিলেন, তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিশোধে কী আর যায় আসে? গোয়েন্দা-কাহিনী আর বীরগাথার পার্থক্যই বা তাহলে কী?

৩। দিল্লীর রাজা বলেই পৃথ্বীরাজ সম্রাট নন্, বরং তিনি ক্ষুদ্র মরু-অনতিদূর আজমীরের রাজা দিল্লী যাঁর উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত। সেই সময়ে রাজসূয় যজ্ঞ করবার মত আতিশয্য ছিল বর্ধনকালোত্তর কান্যকুব্জের রাজা জয়চাঁদের— এবং ‘পৃথ্বীরাজরাসো’ পড়ে এ-কথা মনে করার একেবারেই কারণ নেই যে কেবল পৃথ্বীরাজের গোঁফে-মোচড়-দিয়ে বাগড়া দেওয়াতেই সে সোনার ভিক্ষাপাত্র তাঁর হাত থেকে ফস্‌কে গেল, কারণ পৃথ্বীরাজের রণক্ষমতা প্রমাণিত হয়ে গেছে পরের অধ্যায়েই যেইখানে জয়চাঁদের কিছু সৈনিককে মাত্র দুইদিন ঠেকিয়ে রাখতে গিয়েই বেচারি পৃথ্বীরাজের দুই-তৃতীয়াংশ সৈনিক অকারণে হত হল। সেই দুই-তৃতীয়াংশ ঘোরীর সাথে পরাজয়ে প্রাণ দিলে দেশের মাটি কপালে মেখে শহীদ হত, আর না প্রাণ দিলে বা না হারলে ভারতবর্ষের অন্য ভবিষ্যৎ কপালে থাকত। কিন্তু পৃথ্বীরাজের বসন্তোজ্জাপনের জন্য নরবলিতে যে সুতীক্ষ্ণ লজ্জা— এই বীর মৃত্যুঞ্জয়দের তাই কি প্রাপ্য ছিল?
    কর্ণেল জেম্‌স্ টড্ ভারতের একটা প্রদেশ একবারে অজ্ঞতা নিয়ে দেখা শুরু করে যে পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করেছেন তাঁর কর্মজীবনে এবং তাই দিয়ে যে প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন তাতে তাঁর উৎসাহ এবং পাণ্ডিত্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ না করে উপায় নেই। সেইখানে তিনি যদি মনে করে থাকেন যে পৃথ্বীরাজ ভারতবর্ষের শেষ হিন্দু ‘সম্রাট’ তাঁর লব্ধ তথ্যে সেই নির্ণয় নেওয়াতেও কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া তাঁর ধারণা হয়েছিল পৃথ্বীরাজ চৌহান রাজপুত, যদিচ ‘রাজপুত’ অভিজ্ঞানের তখনো উদ্ভবই হয়নি— যেহেতু তাঁর উত্তরসুরীরা রাজপুত বলে পরিচিত। এসব অতি সামান্য ‘স্লিপ্ অব্ টাঙ্গ্’ যা ধরাই উচিত না। তাছাড়া এরিক টিঙ্কার বেলের মতই কর্ণেল টড্ তাঁর লেখার মধ্যে চরিত্রগুলোকে নাটকীয়ভাবে, পাঁচালীকাব্যের আঙ্গিকে দোষ-গুণ-ঘৃণা-ভালবাসার ব্যাখ্যা দিয়ে সাজিয়েছেন। তাঁর ভঙ্গি কেবল তথ্যপ্রদানের নয়, পরম্পর গল্প বলার। কিন্তু সেই থেকে আমাদের জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে ঢুকে গেছে সেই শব্দত্রয়ী, যা আজও অবুঝের মত উচ্চারিত হয়ে চলেছে। যেমন ঝান্সীর রাণীকে নিয়ে একটা রূপকথায়িত ‘ক্রেজ্’ তৈরী হয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে। এ-কথা নির্দ্বিধায় সত্য এবং পারসিক সাহিত্যেও বহু-উল্লিখিত যে পৃথ্বীরাজের পরাজয় ভারতবর্ষের পরাধীনতার একটা বড়ো ‘ল্যাণ্ডমার্ক’ এবং তুর্কদের দ্বারা সাংস্কৃতিক উপনিবেশ-স্থাপনের একটা বড়ো পদক্ষেপ। কিন্তু পৃথ্বীরাজকে শেষ হিন্দু রাজা বললে হরিহর, ছত্রপতি, কৃষ্ণদেবরায় এবং ভারতবর্ষের বহু স্বাধীন ক্ষুদ্রায়তন রাজ্যের রাজাদের অমর্যাদা হয়। কৃষ্ণদেবরায়কে সম্রাট না বললে সত্যের অপলাপ হয়— সাম্রাজ্যের আয়তন মাপতে হলে ত সিকন্দর শাহ্ ব্যতীত আর কোনো সম্রাটই জন্মগ্রহণ করেননি সসাগরা ধরণীতে। বাবুর, বিজাপুর, গোলকোণ্ডা, কলিঙ্গ, বাহমনী— কলিঙ্গ বাদ দিলে বাকী চার ক্ষুব্ধ ক্ষুধার্ত তক্ষকের মত হিংস্র প্রত্যাশায় উৎখড়্গ বিদেশী শক্তির মাঝখানে কেবল বিজয়নগরের স্বাধীনতাই নয় সংস্কারও যে নৃপতি অক্ষত রাখতে পারেন, তিনি এক ভারতসম্রাটের ভ্রাতুষ্পুত্র আর আরেকজনের পিতা সপ্তরথী-ঘেরিত অভিমন্যুর চেয়ে কম পরাক্রমশালী কি? ভারতের অন্ধযুগে সেই বিজয়নগর কি হিন্দু সাম্রাজ্যের মশালের মত নকল বুঁদিগড়ের রক্ষী একা কুম্ভ হয়ে বহুদিন জাতির স্বাভিমান অক্ষুণ্ণ রাখেনি? লোকালয়ের আয়তনে সম্ভবতঃ পৃথ্বীরাজের অধীন ভূমির থেকে বড়োই ছিল। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দেশনায়ক ‘জান্-ই-হিন্দ্’ সুভাষচন্দ্রের কথা ত ছেড়েই দিলাম। পৃথ্বীরাজ সম্রাট-ই বা কেন, আর শেষ হিন্দু শাসকই বা হতে যাবেন কোন্ দুঃখে?

 

ক্রমশঃ…

Comments

Popular Posts