জয়দেব গোস্বামীর কাব্যের কিছুু নিহিত ব্যাখ্যা

[সংস্কৃত উদ্ধৃতিসমূূহের অনুবাদ ও উৎস নিচে সংখ্যা-অনুযায়ী দেওয়া আছে।]

‘ত্বমসিমমজীবনম্ ত্বমসিমমভূষণম্ ত্বমসিমমভবজলধিরত্নম্’ [১]— রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এইখানে এসে ক্র্যাফট্‌স্‌ম্যান পাঁচালিকার জয়দেব হঠাৎ করে তাঁর সমসাময়িক ভাষাবৈশিষ্ট্যের আগল ভেঙে অমরত্ব লাভ করেছেন। আমি রবীন্দ্রনাথের স্কেপটিসিজম্ নিয়ে অবশ্য জয়দেব গোস্বামীর প্রতি অবিচার করতে চাই না; হিন্দু মূর্তিপূজক জয়দেবের হৃদয়পদ্মে তোলা কালিদহের ঢেউয়ের অনেকগুলি হিল্লোলই রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করবে না। কিন্তু ‘ত্বমসিমমভূষণম্’?— প্রিয়ার রাগ ভাঙাতে গিয়ে নির্মম যোগনিয়ন্ত্রা সহজ প্রথাগত প্রবোধের ইডিয়ম্যাটিক ফ্রেজ-কে অতিক্রম করে গেছেন, মুহুর্তের সেই সংস্কারগত অভ্যাসকে শুধরে নিয়েছেন সেই ভাষায় সেই উপমায় সেই বাচনভঙ্গিতে, যাতে তিনি কথা বলবেন আড়াই দশক পরে তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে সেই বন্ধুর এক ভয়ানক অপ্রস্তুত মুহুর্তে। এ তো সেই শ্রীকৃষ্ণই যিনি বলবেন ‘বাসাংসিজীর্ণাণিযথাবিহায় নবানিগৃহ্ণানিনরোঽপরাণি’ [২]— জীবনের সব সঞ্চয় যাঁর কাছে বসনের মতো পরিত্যজ্য ও পরিবর্তনীয়— সে দেহ হোক্ বা প্রতিষ্ঠা— সে-কথা শ্রীরাধা না-হয় জানেন না কিন্তু জয়দেব তো জানেন। তাই তাঁর লেখনীতে, নাস্তিকের মতো কেবল শূন্যসার প্রলাপের দ্বারা ‘হৃদয়বিহারিণী’কে কী করে শান্ত করবেন মূর্ত্ত বেদান্ত ‘কলিতললিতবনমাল’ [৩]? তিনি বলছেন, ‘প্রিয়তমা, তুমি আমার জীবন। কিন্তু জীবন যে ‘নলিনীদলগতজলমতিতরল’ [৪], পরিবর্তনশীল, হননসাপেক্ষ— তা আমার চেয়ে ভালো করে কে জানে? বসনের মতো জীবন একদিন পড়বে খসে, দেহগত সকল ক্লান্তি গ্লানি আবেগ অভ্যাসের ভারের সঙ্গে— তার মধ্যিখানে তুমি আমার সেইটুকু আনন্দ, বসন হিসাবে যার তাৎপর্য মারাত্মক নয়, কিন্তু সবচেয়ে যত্নের, সবচেয়ে চোখে পড়বার মতো, দেখাবার মতো বা আগলে রাখবার মতো যক্ষের ধন যেইটুকু— আমার অলংকার!’ এ মিথ্যা প্রবোধ নয়, বড়ো সুন্দর করে বড়ো দার্ঢ্যের সঙ্গে বলা ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ বড়ো সত্যি কথা। অলংকারের সংজ্ঞা কে স্থির করবে? পলাশফুল আর সামন্তকমণির অলংকারের কী পার্থক্য? ‘বৈদূর্য্যমণি মকরমুখ ময়ুরপুচ্ছ— এরা আমার পরিধেয় মাত্র, দেহমাত্রের অভিজ্ঞান। কিন্তু সবার আগে রাধা তুমি আমার পরিচয়। আমার স্খলমান সঞ্চয় নও, আমার আদরের ধন।’
 
        বসন— জীর্ণ সিক্ত বসন গায়ে জড়িয়ে ভবসাগরের মধ্যে উথালিপাথালি মানবতা; ভবসাগরতারণই তার চিরকাল উপাস্য। ভবসাগরত্রাণের মাহাত্ম্য যে অনতিদূর অতীতে জয়দেবের সময়ে ছিল তার জন্য সমসময়ে শঙ্করাচার্য বা অন্যদের লেখা খুঁজতে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই— ‘অমলকমলদললোচন ভবমোচন ত্রিভূবনভবননিধান’ই [৫] তার প্রমাণ। চিরকালীন অ্যলেগরিটিই এই— রূপসাগরে ডুব দিয়ে অরূপরতন সন্ধান করে চলেছেন সন্ন্যাসীরা যুগযুগান্তর ধরে, অবতারকল্প পরমহংস সেই কালসলিল গায়ে না লাগিয়ে ভেলা হয়ে নিয়ে চলেছেন অনুসারীদের ‘অভয়ম্ তিতীর্ষতাং পারম্’, ভবসাগরের ঐপারে— ‘য সেতুরীজানানাম্—’ [৬]। তার মধ্যে অবতারশ্রেষ্ঠ সদর্পে ঘোষণা করছেন, ‘আমি ভবসাগরের তরঙ্গের তলাতেই পেয়েছি সেই দুষ্প্রাপ্য পরম ধন; হ্লাদিনীর প্রেমরক্তিম শৃঙ্গারে যখন শেষ প্রসাধন কুঙ্কুমবিন্দুটি আঁকা হয়েছে, তার পটভূমিতে ধ্বনিত হতে শুনেছি প্রণবনাদ; তার গুল্মবাহুর বেষ্টনে ধরা দিয়েছে দ্যুলোক; তার অঙ্কের শীতল শয্যা গেছে মহাশূন্যের নীরব নিশির মধ্যে হারিয়ে। সেই আদরিণী তার হৃদয়নৈবেদ্যের অর্ঘ্যডালিতে সাজিয়ে আমার জন্য অরূপরতন এনে দিয়েছে, কোন্ অভিমানে তার সেই ঋণ আমি অস্বীকার করতে পারি? আমি শুধু ধন্য হলাম, ‘বেদাহম্ এতম্ পুরুষম্ মহান্তম্’ [৭] আমার মানবজন্ম সার্থক হল। রাধা, ত্বমসিমমভবজলধিরত্নম্!’

সংস্কৃত উদ্ধৃতির সূত্র—
[১] “তুমি আমার জীবন, তুমি আমার ভূষণ, তুমি আমার ভবসাগর হ’তে উদ্ধৃত রত্ন”। জয়দেব গোস্বামী, ‘গীতগোবিন্দম্’।
[২] সম্পূর্ণ বক্তব্যের ভাবার্থ— “মানুষ যেমন জীর্ণ বসন পরিত্যাগ করে নতুন বসন পরিধান করে, তদ্রূপ আত্মা জীর্ণ দেহকে পরিত্যাগ করে নতুন শরীর পরিগ্রহ করে।” ভগবদ্গীতা, সাঙ্খ্যযোগ।
[৩] জয়দেব গোস্বামী, ‘গীতগোবিন্দম্’।
[৪] … তদ্বজ্জীবিতামতিশয়চপলম্। পদ্মপাতার ওপর জলবিন্দুর অস্তিত্ব যেমন অনিশ্চিত, তেমনি জীবনও চপলস্বভাব। শঙ্করাচার্য, মোহমুদ্গর।
[৫] ‘ভব-মোচন’ দ্রষ্টব্য। জয়দেব গোস্বামী, ‘গীতগোবিন্দম্’।
[৬] “মুক্তি-তৃষ্ণার্তদের অভয়-প্রদানকারী ভবসমুদ্রের পার— যজ্ঞ করেছেন যাঁরা, তাঁদের দ্বারা প্রার্থিত সেতু।” কঠোপনিষদ্।
[৭] “আমি সেই মহান্ অস্তিত্বকে চিনতে পেরেছি।” তৈত্তিরীয় উপনিষদ্।

Comments

Popular Posts