দ্বিধা-ত্যক্তা

শ্রীহট্ট থেকে নীলাচল, মধ্যে নবদ্বীপ, মহাপ্রভুর দেশ। বিক্রমপুর থেকে বিক্রমশীল, মধ্যে রাঙামাটি, অতীশ দীপঙ্করের দেশ। এই দেশে প্রত্যেকটা মন্দিরের প্রত্যেকটা ইঁটের হিসাব ঠিকই শোধ হবে। ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের হিন্দু জেনোসাইডের সমর্থক কিছু বামপন্থী বা উগ্রপন্থী তাদের প্র্যোপ্যাগ্যাণ্ডার অংশ হিসাবে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনে পাহারারত কিম্বা নমাজপাঠরত কয়েকজন মুসলমানের (যাদের বেশভূষায় ঐ পরিচয়টি অস্বাভাবিকমাত্রায় স্পষ্ট) ছবি দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে, ‘কই, কী আবার হয়েছে?’ এদিকে পূর্ববঙ্গের কোণায় কোণায় মন্দির ভাঙছে, হিন্দুরা জবাই হচ্ছে, অপহৃতা মেয়েদের কান্নায় আকাশ হয়ে উঠেছে আষাঢ়ের মেঘের মতো অন্ধকার। আমার চাই না ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সামনে পাহারা। তোদের হিম্মৎ থাকে তো ভেঙে যা। সিলেটের পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ভগ্নবিগ্রহ রক্তাক্ত কালীমন্দিরের কালীমূর্তির সঙ্গে ঢাকেশ্বরীর কোনো পার্থক্য নেই। ঐ ভাঙা মন্দিরের কালী, হত পূজারীর নির্যাতিতা কন্যা, একদিন জেগে উঠবে কৈলাশেশ্বরীর মর্ত্য আবির্ভাব হয়ে। মসজিদ-টসজিদ নয়, আততায়ীদের ভাঙা হাড়ের ওপর দিয়ে হবে শ্মশানের দেবীর মর্ত্যলীলা।

ধুলা-মাখা ঐ চরণের ক্ষতে
রক্তে রাঙা’, মা, শ্বেত-জবা!
লক্ষ্মী মেয়ে, তোর মাধুর্য্য-ব্রতে
আজ ভুলে— জাগা’ সুর-সভা!

সাগ্নিক ঋষি নীর-তর্পণে
চীর-অর্পণে পরাক্ বেশ,
মানস-সরসী স্থির দর্পণে
এলোখোঁপা বাঁধ্ রম্যকেশ।

নীলকণ্ঠের কালকূট-জ্বালা
পরশি’ অধরে, চুমি’ ও ঠোঁট,
সাগরের হাহাকারে, গিরিবালা,
বৈশাখী ঝড় সেজে, মা, ওঠ্।

অসুর-সৈন্য দ্যুলোকের দ্বারে—
হৃতা অপ্সরা শেক্‌লি-পায়ে;
আল্‌সে ইন্দ্র বেধড়ক মারে
ফেলে রাজপাট, দূর কোথায়!

মন্দাকিনীর ঝর্ণার স্রোতে
দেবদুহিতার কান্না ধোয়,
লক্ষ্মী মেয়ের সহবত-ব্রতে
বে-আদব নখ দৈত্য ছোঁয়।

ভাগীরথীর ঐ হিমবাহ-ধারা
লোহিত দেবতাদের খুনে,
লুটায় ধুলাতে ঐ ধ্রুবতারা,
চাঁদ রাহুগ্রাসে যায় শুনে।

খসা আঁচলটি নে, মা গো, তুলে,
দু-আঁখির কোলে মোছ্ না জল;
রুধিয়া হৃদয়-সমুদ্রকুলে
হাহাকার ঢেউ দুখ অতল;

চূর্ণ চিকুর বাঁধ্, মা, চূড়ায়,
আঁচড়ের ক্ষত হোক্ কবচ;
কবর খুঁড়িয়া নে মা কুড়ায়ে
মর্‌চে-ধরা অসঙ্কোচ।

শিবের ত্রিশূল সুদর্শনে
লেগেছে অব্যবহারের জং
বন্দিনী মা গো, পর যতনে
কপোল-সিঁথেয় লোহিত রঙ!

ঊমা মা, শিবের অভিসারে
গেছিলি যেই তপস্বিনী,
অমরাবতীর ভগ্ন দ্বারে
আজ চলো মা লজ্জা জিনি’।

শিবের থাকুক্ ভাঙের নেশা
বিষ্ণু ঢলুক্ মায়ার নিদে,
উচ্চৈঃশ্রবার দর্পী হ্রেষা
বাজুক্ মা সন্ত্রস্ত হৃদে।

আঁধার মুখে আঁধার কোণে
হিমালয়ের আদুরে মেয়ে
কম্প্র বক্ষে বিক্ষত মনে
থেকে দেখেছিস্ শূন্যে চেয়ে;

আসেনি ইন্দ্র উদ্ধত রোষে
বজ্র-বারুদ-স্তুপ জ্বেলে,
দেব-সেনাপতি অপদার্থ সে—
তর্ক করে লড়াই ফেলে।

আঁচলে লেগেছে অসুরের নখ,
কেঁদে দুই চোখ হয়েছে লাল;
গৃহবধূ-সাজ, প্রসাধিত ত্বক
পোড়াতে আঁখিতে অগ্নি জ্বাল!

কৌষাণী কালী, সহবতহীনা—
দ্রব-করুণার চণ্ডী রূপ—
খড়্গ হোক্ ঐ তার-ছেঁড়া বীণা,
গর্জন হোক্ কান্না চুপ!

চল্ মাতঙ্গি অসি-হাতে, মা গো,
তুই কাঁদলে, মা, রক্ষে কার?
সিংহবাহনা রুদ্রাণি, জাগো,
লাল জবা— নীলকণ্ঠহার!

Comments

Popular Posts