জ্যেষ্ঠ কৌরব, প্রকরণ-২

 
 
॥ শরশয্যা॥
 
ভীষ্ম— এস বাসুদেব।
 
কৃষ্ণ— আপনি জেগে আছেন পিতামহ?
 
ভীষ্ম— তোমার অপেক্ষায় জেগে আছি। তুমি যাকে দেখা দিতে এসেছ সে কি ঘুমিয়ে থাকতে পারে?
 
কৃষ্ণ— এ নিয়েই ত যত গোল বাধে পিতামহ। আমি ত সবার কাছে চিরলভ্য। আমি ত বাতাসের মতই অদৃশ্য ও চিরন্তন। আমি ত সূর্যালোকের মতই সত্য। আমি ত সবার চোখের সামনে দিয়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু আপনি, দ্রোণাচার্য্য, সঞ্জয়, ক্ষত্তা বিদুর আর অর্জুন ব্যতীত কে আমাকে চিনল?
 
ভীষ্ম— অর্জুনকে তুমি তোমার পরিচয় দিয়েছ, বাসুদেব। তারপরে সে চিনেছে। আর কাকে দিয়েছ সে পরিচয়? আমাকেও ত দাওনি। আমি তোমায় চিনেছি কীভাবে জান? আমি তোমারই অপেক্ষাতে বসে আছি বহুদিন ধরে। তোমাকে আগেও একদিন বলেছিলাম— তুমি এসে সেই সব ধুয়ে দেবে যা আমরা স্তূপিকৃত করেছি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। করেছেন যযাতি অতিরিক্ত ভোগে, করেছেন ধৃতরাষ্ট্র স্বভাব-অন্ধত্বে। সেই পাপ যা ঘটেছিল হস্তিনাপুর-সংলগ্ন ধীবরদের বসতিতে। সেই পাপ যা ঘটেছিল বিচিত্রবীর্যের আমোদকক্ষে। সেই পাপ যা ঘটেছিল বারাণাবতে বা প্রকাশ্য সভায়। আর সেইদিন জীবনের ভার ধুলাপ্রলেপিত বসনের মত পরিত্যাগ করে আমি তোমার সাথে লীন হয়ে যাব। তোমাকে জীবদ্দশায় দেখা আর কর্মজালমুক্ত হওযা আমার কতবড়ো সৌভাগ্য তা তুমি বোঝ? আর ত মাত্র কয়েকদিন; তারপরে আমার ছুটি— তোমার কাছে তোমার লোকে থাকব আমি আবহমান কাল ধরে। তোমাকে চেনার যে আমার ভারী ব্যগ্রতা।
 
কৃষ্ণ— আমাকে চিনলেন ত। আমাকে সাহায্য করলেন কই?
 
ভীষ্ম— এ প্রশ্নের উত্তর তুমি এখনও চাও? তবে শোন, আমি তোমার কাছে কতটা কৃতজ্ঞ, তা কল্পনা করার সাধ্য তোমারও নেই। যদি আমি দেখতাম আমার পাঁচ পৌত্র কেবল দুরভিসন্ধ দ্রুপদ আর উদ্ধত অভব্য ধৃষ্টদ্যুম্নর সাথে হস্তিনাপুরে ফিরে আসছে এত বছর পরে, আমি তাদের কথা ভেবে শঙ্কিত হতাম। এক, এই কারণে যে ভীমার্জুন বীর হতে পারে কিন্তু হস্তিনাপুরের ক্ষত্রকুলকে দুর্যোধনও কম গর্বিত করেনি। আমি প্রতিজ্ঞবদ্ধ। তাই শঙ্কিত হলেও তাদের পাশে দাঁড়াতে পারতাম না হয়ত। না, পারতাম না। কিন্তু তাদের জন্য আমি অনেক বেশী ব্যথিত হতাম। কেন জান? তাদের পক্ষে ধর্ম থাকত না। যে কোনও পরিস্থিতিতেই, যে কোনও অপমান বা বঞ্চনার পরেও, নিজের মাতৃভূমিকে বিদেশী সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করা অধর্ম। তার চেয়ে সন্ন্যাসগ্রহণ বাঞ্ছনীয়, অন্ততপক্ষে বিষপানে নিজেকে পরিত্রাণ করা উচিত।
    কিন্তু এখন আমি বুঝেছি— তোমায় দেখে— যে হে বাসুদেব, এ সবই তোমার এক বৃহৎ পরিকল্পনার অঙ্গ। তোমার সারথ্যগ্রহণ আমাকে নিশ্চিত করেছে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। যা তোমার উদ্দেশ্যসাধন তা অধর্ম হতে পারে না। তুমি তাদের ধর্ম দিয়েছ, লক্ষ্য দিয়েছ, আশ্রয় দিয়েছ। তারা তোমার দাস, তাই পরিত্রাত। আমাকে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হত। আর দর্পপ্রকাশ না করেও বলছি, তাহলে আমি এই ভেবে শঙ্কিত হতাম তাদের মর্মান্তিক পরিণতিলাভের পরে আমি পাণ্ডুর স্মৃতিচিহ্নকে মুখ দেখাতাম কী করে? এখন আমি অর্জুনের সাথে যুদ্ধ করিনি, হে বিশ্বম্ভর, আমি তোমার সাথে যুদ্ধ করেছি। সেখানে আমার বিজয়লাভের ভয় ছিলই না। তোমার পথে বাধা হওয়া ত শুধু খেলা, পরাজয় যে খেলায় নিশ্চিত, তোমাকে নাকানিচোবানি খাওয়ানো সেই খেলার লক্ষ্য। আমি সেই খেলায় তোমাকে যথেষ্ট নাকাল করেছি, করিনি? তুমি আমার ধর্মসঙ্কটকে খেলায় রূপান্তরিত করে দিয়েছ, গোবিন্দ।
 
কৃষ্ণ— আমাকে ভর্ৎসনা করে কি বিবেকমুক্ত করতে পারতেন না আজ পিতামহ?
ভীষ্ম— অর্থ?
 
কৃষ্ণ— আজকে আমি আপনার কাছে দেবত্বের অধিকারে কোনও অনুরোধ নিয়ে আসিনি। এসেছি আমার নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। আপনি জ্যেষ্ঠ কৌরব, মহাজ্ঞানী। তাই আমি আপনার কাছে উপদেশ শুনতে এসেছি।
 
ভীষ্ম— কী শুনতে চাও? যা তোমায় শোনাব, তা তুমিই একদিন কোনও ঋষিকে শুনিয়েছিলে। তারপরে বহুবক্তৃতায় বিকৃত হয়ে তা আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। তাইই কি তুমি শুনতে চাও? কেন এই আত্মছলনা? তুমি নিজেই জান সকল জাগতিক কার্য্যকরণ।
 
কৃষ্ণ— আত্মছলনা? সবাই যে বলে আমি অন্যদের সাথে ছলনা করি?
 
ভীষ্ম— আমার সাথে তুমি ছলনা করবে না, জানি। কারণ আমি কোনওদিন তোমার সাথে ছলনা করিনি। আমরা কি একে অন্যের প্রতিচ্ছবিই নই? মাধব, আমি কোনওদিন কাপট্যের সাথে অসদুদ্দেশ্যপ্রণোদিত সুসৎকার করিনি তোমার। না আমি কোনওদিন নিজের বিবশতার মিথ্যা কারণ বলেছি। আমি যা তুমি ত জান সবই। আর তুমি কে তাও জানতে আমার বাকি নেই।
 
কৃষ্ণ— আজ আমি যেই মুহুর্তে আপনাকে শরশয্যায় ভূমিস্পর্শ করতে দেখলাম, আমার দুটো উপলব্ধি হল। একটি আমি এতদিন খুব চেষ্টাকৃতভাবে মনের অগোচরে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ ঐ মুহূর্তের ধাক্কায় তা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি অজ্ঞানতাবশতঃ ভারতবর্ষকে মনীষাশূন্য করার পরিকল্পনা করেছি/করতে নেমেছি। আপনি, গুরু দ্রোণাচার্য্য, মহাবীর কর্ণ— এরা কেউ যুদ্ধের শেষের পৃথিবীটায় যদি না থাকেন— আমি ত সামনে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখছি না। আর, দুই— শিখণ্ডীর কুৎসিত হাসিটা দেখে আমার গা জ্বলে গেল! মনে হল— চূলায় যাক্ ধর্মযুদ্ধ— এই অসভ্য ঘৃণ্য কীটসুলভ নরপিশাচটির অসাধু উদ্দেশ্য সফল হতে দেওয়া আমাদের দারুণ পাপ হয়েছে। যেনতেনপ্রকারেণ একে ব্যর্থ করাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মাচরণ! আমাকে পথ দেখান্, কৌরব।
 
ভীষ্ম— যতদূর আলো আর অন্ধকারের প্রশ্ন— সে দুইই ত তোমারই প্রকাশ, হে বার্ষ্ণেয়! তোমার কাছে ত তাদের দর্শনে কোনও পার্থক্য থাকার কথা নয়। আর, আমাকে রোধ করা প্রয়োজনীয় যদি ছিল, সে পথে এসে পড়ে তোমার পুণ্যস্পর্শে যদি কাশীরাজকন্যা ভবনদী তরে যায় তাতে ক্ষতি কী?
 
কৃষ্ণ— এ ত প্রবোধ হল পিতামহ। এ ত আমার প্রশ্নের উত্তর হল না।
 
ভীষ্ম— তোমার উত্তর তোমাকে নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। কারণ তোমার পথ সাধারণের অনায়ত্ব, আর সেটা খুঁজে বের করাই তোমারও পরীক্ষা। তুমি কাল সুর্যোদয়লগ্নে আমার সঙ্গে দেখা করতে এস। তখনও যদি তোমার মনে প্রশ্ন থাকে, তখন আমরা আবার এই নিয়ে আলোচনা করব। শিবিরে ফিরে যাও। অর্জুনের অশ্বরাও ক্লান্ত। তাদের পরিচর্যা প্রয়োজন। তুমিও ক্লান্ত। তোমার নিদ্রা প্রয়োজন। তুমি ঘুমাও না, আমি জানি। বিশ্রাম নাও। এখন অনেক রাত্রি। সারা পৃথিবী এখন সুপ্ত। কর্ম এখন বিরত। এখন এক দণ্ড তোমার চোখ লেগে গেলে কোনও অনর্থ হবে না।

(উল্লেখ্য, শ্রীকৃষ্ণ পরের দিন প্রত্যুষে আর আসেননি। ভীষ্ম বেঁচে ছিলেন আরও যে কয়দিন, তাঁর সাথে কুরুপিতামহর আর কথা হয়নি। ভীষ্ম যখন যুধিষ্ঠিরকে অনুশাসন শেখাচ্ছিলেন, তখনও কৃষ্ণ যুধিষ্ঠির আর অর্জুনকে নিয়ে এসে সামনে এগিয়ে দিয়ে নিজে দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। এরপরে ভীষ্মের চিতায় তিনি একমুষ্টি এরকা ও একটি বাঁশি নিক্ষেপ করেছিলেন। বাঁশিটি তাঁর নিজের, এরকাগুচ্ছও তাঁরই।)
 
সমাপ্ত॥

Comments

Popular Posts