জ্যেষ্ঠ কৌরব, প্রকরণ-১

painting: Gaganendranath Tagore

॥গঙ্গাতীর, শ্রীকৃষ্ণের ব্যর্থ শান্তিদৌত্যের সন্ধ্যায়॥

ভীষ্ম— মা গঙ্গা, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব? তোমার কাছে আমি অনন্তকাল বাঁধা মা গো; তাই ত সেদিন যখন আমার প্রাণাধিক অর্জুন আমায় এসে পায়ে পড়ে অনুরোধ করল তাদের পক্ষে যেতে, আমি বললাম, ‘হস্তিনাপুর ছেড়ে আমার কোথাও যাবার নেই। যে আমার হস্তিনাপুর আক্রমণ করবে, আমি প্রাণ দিয়ে তাকে প্রতিরোধ করব।’ সেইই আমার একমাত্র কর্ম।

শ্রীকৃষ্ণ— যেতুসর্বাণিকর্মাণিময়িসন্নস্যমৎপরা। অনন্যনৈবযোগেনমান্ধ্যায়ন্তউপাসতে॥

(একে অপরকে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে)

শ্রীকৃষ্ণ— আশীর্বাদে কেন এই কার্পণ্য, হে কুরুশ্রেষ্ঠ?

ভীষ্ম— তোমার কার আশীর্বাদের প্রয়োজন আছে মাধব? কে দেবে তোমায় আশীর্বাদ?

শ্রীকৃষ্ণ— বৃক্ষ যখন ছায়া দেয় তখন পথিকের প্রয়োজন সে বিচার করে না। পথশ্রান্তকে যেমন সে আশ্রয় দেয়, তেমনই প্রলুব্ধ করে অশ্বারোহী উদ্যমীকেও।

ভীষ্ম— তোমাকে ছায়া দেবার আমার কী অধিকার আছে কৃষ্ণ? তুমি ছায়া দিয়েছ আমার অর্জুনকে, আমি তাই কৃতজ্ঞ। আমি তাকে দিতে পারিনি আশ্রয়, সে দুঃখ আমার মরলেও যাবে না।

কৃষ্ণ— আমার কাছে কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না পিতামহ। আমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে নেই। চেয়েছেন দিতে তাদের আশ্রয় ও আদেশ? যে বৃক্ষ আপনি যথার্থই, কখনো প্রকাশ করেছেন তার আচরণ বা আস্ফালন?

ভীষ্ম— তুমি জান বাসুদেব, আদেশ করার অধিকার আমার নেই। আমি হস্তিনাপুররাজের আজ্ঞাবাহী চিরায়তঃ। আর কী আদেশ তাদের করব? দুর্যোধন শুনবে না আমার আদেশ, তাকে দিয়ে কিছুই করাবার ক্ষমতা আমার নেই। এখন আমি যদি যুধিষ্ঠিরকে আদেশ করি যে ‘বৎস, রক্ষা কর আমার হস্তিনাপুরকে’ হবে তা দুর্বলের ওপর অত্যাচার। কারণ, সে হয়ত আমার কথা শুনবে। আমি যদি ন্যায় দিতে না পারি তাকে, দমন করতে না পারি তার শত্রুদের, তবে তার আনুগত্যের অপব্যবহার করা আমার অধর্ম হবে।
    তবে, আশ্রয় আমি হতে চেয়েছি তাদের।

শ্রীকৃষ্ণ— আদেশের নিশ্চয়তা ব্যতীত আশ্রয় যথার্থ হয় না পিতামহ; রাজা তাইই প্রজাদের আশ্রয় হন্।  আর এখানে হয়ত’র প্রশ্ন নেই পিতামহ। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনি যদি এই মুহুর্তেও আজ্ঞা করেন, যখন সবই নির্ধারিত হয়ে গেছে আজ কুরুসভাগৃহে— তবুও— যদি আপনি আদেশ করেন আমাকে, হবে না এই যুদ্ধ। যুধিষ্ঠিরের হয়ে আমি কথা দিয়ে পারি।

ভীষ্ম— কেন এ অর্থহীন নির্যাতন বাসুদেব? কে দেবে তোমাকে আদেশ? কে দিতে পারে? যুদ্ধের শেষে তুমি কি বলতে চাও এই যুদ্ধের জন্য আমি দায়ী?

শ্রীকৃষ্ণ— যুদ্ধের শেষ ত অনেক পরের কথা, হে প্রাজ্ঞ। আপনি জানেন, কী ঝঞ্ঝা আজ তোলপাড় করে তুলছে শুধু হস্তিনাপুর নয় সমগ্র ভারতবর্ষের নক্ষত্রমণ্ডলী। দুর্যোধন ত অন্ধ তার পিতার মত, কিন্তু আপনি নন্। আপনি কি বলতে চান, এতদিন যা ঘটেছে, উত্তরকাল তা নিয়ে কিছুমাত্র প্রশ্ন করবে না আপনাকে? আপনি কি বলতে চান, আমরা সকলেই দায়ী নই এই ঘটনার জন্য, নিজ নিজ স্বার্থের সম্মোহনে? দুর্যোধন কি একা স্বার্থপর? ধৃতরাষ্ট্র কি একা প্রলুব্ধ?

ভীষ্ম— আমরা সকলেই দেখেছি দ্রৌপদীর নিগ্রহ কুরুসভায়। এক রাজ্ঞীর নিগ্রহ, এক পঞ্চপুত্রবতী নারীর নিগ্রহ, সর্বোপরি— আমার পৌত্রবধুর নিগ্রহ। চুপ করে আমরা দেখেছি, ধর্মতত্ত্বের জাল বুনেছি। দুঃশাসন ছুঁয়েছে তার আঁচল; কে ছিল সেই কুরুসভায় যে অন্ততঃ চোখ দিয়ে, প্রবৃত্তিবশতঃই, লেহন করে নি তার নিরাবরণতা? কেন সর্বচক্ষুসমক্ষ ছিল তার জন্য অপমান? তার উৎস কি নয় চোখেই? আর আমরা, বৃদ্ধেরা, আমরা চুপ করে দেখেছি যৌবনশক্তির এই চূড়ান্ত অপচয়। যুদ্ধে নয়, এমনকী মৃগয়াতেও নয়, নারীনির্যাতনে আস্ফালন, আর আমোদ।

শ্রীকৃষ্ণ— দ্রৌপদী বড়ো কথা নয় পিতামহ; ক্রন্দনকে কেউ মনে রাখে না। যুদ্ধের কারণ হল পুঞ্জীভূত পাপ, যা জমেছে বহু বছর ও প্রজন্ম ধরে। আপনি ভাববেন না যুদ্ধের উত্তরদায়িত্ব থেকে আমি, বা মহাকাল, মুক্তি দেবেন যুধিষ্ঠিরকে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন, এই যুদ্ধ তারই অপদার্থতার ফলস্বরূপ। তেমনই, কর্ণ— আপনি হয়ত জানেন তাঁর প্রকৃত পরিচয়, বা অনুমান করেছেন— তিনি পাণ্ডবপক্ষে এলেই হয়ে যায় সব সমস্যার সমাধান। আমি তাঁকে বৃত্তান্ত জানিয়ে সেই আমন্ত্রণ জানাব, যদিও জানি তিনি করবেন তা প্রত্যাখ্যান। দায়ী তিনিও। দায়ী দ্রোণাচার্য যিনি প্রথম প্রবর্তক কুরুপাঞ্চাল বৈরীতার। দায়ী আমিও, যাঁকে দায়ী বলে চিনে নেবেন গান্ধারী। তেমনই আপনি, পিতামহ, কি পারতেন না, আশ্রয় দিতে বটবৃক্ষের মত কুরুকুলকে আপনার সিংহাসনতলে? যদি কোনো একদিন কোনো এক অবান্তর মূঢ় প্রতিজ্ঞা করে বসতেন আপনার পিতার কাছে?

ভীষ্ম— ধর্ম কি পরিত্যজ্য?

শ্রীকৃষ্ণ— কাকে বলে ধর্ম, পিতামহ? আপনার মনে নেই আপনার পুর্বপুরুষ যযাতিকে, যিনি পুত্র পুরুকে বলেছিলেন, যে অনন্তকাল জীবিত থাকলেও এবং ভোগ করলেও পৃথিবীর সমস্ত মৃগ ও নারী কোনো একজন পুরুষকেও অবশেষে তৃপ্ত করতে পারে না? তবে কেন সে পথে চলন ও নিমজ্জন? তবে কেন আর এক বার কাঙালের মত যৌবনভিক্ষা? তবে কেন একবার কুম্ভীরের মত নিজক্ষুধানিবারণে পুত্রাহুতি? আর আপনার মূর্খের মত লাম্পট্যে প্ররোচনা? অধর্মে প্ররোচনা কোনও পরিভাষাতেই ধর্মাচরণ হতে পারে না, পিতামহ। সত্যবতীর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেও দায়ী করবে উত্তরকাল।

ভীষ্ম— যদি একবার করে থাকি প্রতিজ্ঞা, যখনও জানি নি কী হতে পারে তার পরিণাম, ভেঙে ফেললে আজ আপনি আমাকে এই ভর্ৎসনা করতেন না বাসুদেব। আপনি ভর্ৎসনা করছেন আমি রাজকার্যের যোগ্য ছিলাম বলে; কিন্তু এক সামান্য প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারীকে কি আপনি আর যোগ্য ভাবতেন কুরুসিংহাসনের? তখন হতাম আমিও দুর্যোধনের মতই অনধিকারী।

শ্রীকৃষ্ণ— একটি স্খলনে যোগ্যতা অপ্রমাণিত হয় না পিতামহ। তাতে কীর্তির ক্ষয় হয়। একটি পুষ্পিত বৃক্ষের যদি একটি ফুল ছিন্ন করে নেওয়া হয় বা চ্যুত হয় ঝঞ্ঝায়— এমনকী সব ফুল ঝরে যায়— তবু সে অযোগ্য হয় না; যোগ্যতা প্রমাণিত হয় পরবর্তী বসন্তে। বাস্তবে, যোগ্যতা তার পুষ্প নয় যা প্রদর্শনীমাত্র, যোগ্যতা তার সেই মূল যা প্রমাণব্যতীত সাধারণ মানুষের চোখে ধরা পড়ে না। কেবল আমি দেখতে পাই।
    আপনার মনে আছে, আমার বাল্যকালের উপবন ছেড়ে আমি চলে এসেছিলাম দ্বারিকায়, রণপরান্মুখ হয়ে? জরাসন্ধ আর কালযবন চেঁচিয়ে পিছন থেকে বলেছিল, ‘রণছোড়্’। সেদিনও তুলেছিল আমার হিতৈষীরা এই যোগ্যতার প্রসঙ্গ; বলেছিল, ‘প্রজারা তোমায় কী ভাববে?’ আমি বলেছিলাম, ‘আমার এতকালের সকল কর্ম যদি মিথ্যে হয়ে যায় এই একটি কলঙ্কে, তবে আমি কিছুই জয় করে উঠতে পারি নি তাদের বিশ্বাস। তারা দেখবে আমি এরপর কী করব।’ এরপর, যাদবেরা হাতে হাতে মিলিয়ে নির্মাণ করেছেন দ্বারিকা নগরী। প্রজারা যদি আজকে আমাকে ‘রণছোড়’, সে তবে বলে স্নেহের প্রশ্রয়ে।
    যোগ্যতা এক নিহিত গুণ, যা সাধারণের উপলব্ধির আয়ত্বের বাইরে। আমি তা দেখতে পাই। যদি মনে না রাখতেন প্রতিজ্ঞভঙ্গের গ্লানি, পরবর্তী কর্মকে প্রভাবিত না করতেন তার দ্বারা, তবে আপনিই পারতেন এই ভারতবর্ষকে চালিত করতে। আপনার যোগ্যতার অভাব ছিল না, প্রমাণ হত তা যথাসময়ে।

ভীষ্ম— যে পরীক্ষার আপনি বিচারক, সেখানে প্রমাণের কী প্রয়োজন বাসুদেব?

শ্রীকৃষ্ণ— আমি সব জানি, সেই জন্যই এই হাহাকার আমার একার। লোকে যদি দেখে একটি রোপণ করা বৃক্ষে পুষ্প ধরছে না, তবে দুঃখিত হয়। কিন্তু আমি যে জানতে পারি প্রথম থেকে তার সম্ভাবনাময় চরিত্রকে, আর আমিই সাক্ষী থাকি যে তার পারিপার্শ্বিক তাকে করে তুলল ব্যর্থ— বা সে নিজেও। তাই আমার আক্ষেপ সান্ত্বনার অতীত। সেই আক্ষেপ কখনো উদ্গার করে থাকি ভর্ৎসনায়, কখনো অবোধগম্য আচরণে। আমাকে ক্ষমা করবেন।

ভীষ্ম— ধর্ম ত নির্দিষ্ট কোনো পন্থা নয় বাসুদেব। যার যার ধর্ম তার ব্যক্তিগত, সে ত আপনি জানেন। বৈকর্তন যে ধর্মপালন করছেন না, এ কথা তাঁর পরম শত্রুরও অনুচ্চারণীয়।

শ্রীকৃষ্ণ— প্রত্যেকটি মানুষ পরমাত্মার সাগরে যে একেকটি জলের বিন্দুমাত্র, তা আপনাকে বোঝাবার ধৃষ্টতা আমি দেখাব না, হে প্রাজ্ঞ। তাদের পুঞ্জীভূত (একত্রিত) কর্ম ও পুণ্য সেই সমুদ্রের কল্লোল। লবণের একটি বিন্দু ও সমগ্র সমুদ্রের স্বাদ যেমন অভিন্ন, তেমনই প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই পরমাত্মার সেই সব ক্ষমতা— আর সেই সব স্খলনের সম্ভাবনা— আছে। তবে একটি বিন্দু বারিকণা সমুদ্রের মাঝে নিজেকে হারাতে পারলে যেমন সেইই হয়ে ওঠে নিঃসন্দেহে সমুদ্র স্বয়ং, তেমনই মানুষ ব্যক্তিগত-র ঊর্ধ্বে উঠতে পারলে তখনই সার্থক হয় তার পরমাত্মার প্রকাশ। আর পাপ কী জানেন? সেই সমুদ্রের কোনও একটি অংশে ভাসমান ও ক্রমবিস্তারমান এক আঁজলা বিষ। কোন্ জলকণাটি নিজের সাথে তাকে বয়ে এনে অন্ধ করেছে সমাজকে, তা অবিচার্য্য। সবাইকেই তা প্রভাবিত করে, আর সবার প্রাপ্য সেই গ্লানির উত্তরদায়িত্ব।
    কেন আপনাদের মত কিছু মানুষ বিষের বোঝাটুকু রেখে দেয় নিজের জন্য, আর সকলের থেকে আড়াল করে? যে মানুষ সবার কথা ভেবে ভেবে নিজেকে চড়ায় বিষপানের যুপকাষ্ঠে— সে যখন পরামাত্মার সমুদ্রে তার ভাগের অঞ্জলী দেয় তখন তার সেই হৃদয়ের গরলও ঢেলে দিতে হয়। সে যে নিতান্ত অনুচিত।

ভীষ্ম— এ যুগের বিষ ছেঁকে নেবার জন্য হে নীলকণ্ঠ তমি যখন এসেছ, তখন আমার চিন্তা কীসের? ওরা কেউ তোমায় চেনে না, কিন্তু আমি চিনি। হে বিষপানরত মধুসূদন, তোমার মুখগহ্বরের অনলে যেদিন আহরণ করবে সমাজের মৃত্যোদ্যত সব দুর্লক্ষণদের সেদিন তোমার দন্তধারে নিক্ষিপ্ত হয়ে যদি চুর্ণ হয়ে যেতে পারি— আমার সারা জীবনের সব পাওয়ার মধ্যে তাকে সবচেয়ে মূল্যবান মনে করব।

শ্রীকৃষ্ণ— তার বদলে আমায় কী দেবেন? প্রত্যাখ্যান?

ভীষ্ম— শুভকামনা। মর্ত্যলোকের আয়ুকে যদি প্রবীণত্বের পরিচায়ক মনে কর, তবে আমার অকুন্ঠ আশীর্বাদ। হে চিরনবীন, আমরা প্রাজ্ঞেরা যে ভুল করেছি, আমরা পূর্বপুরুষেরা যে ক্ষতবিক্ষত পাপলাঞ্ছিত পৃথিবী রেখে যাচ্ছি তোমাদের জন্য, তুমি তাকে নিষ্কলুষ কর। একটা সুন্দর পৃথিবী অর্পণ কর ভাবীকালকে। তুমি নীলকন্ঠের মত ধারণ কর যুগের প্রসবপীড়া— এইই আমার প্রার্থনা। তোমাকে চিনেছি— তাই সকল লোভী মানুষের মত আমিও তোমার কাছে প্রার্থনাই করব। তুমি রিক্ত হাতে আমাদের অপকীর্তির বোঝা বইবে?

শ্রীকৃষ্ণ— হে পিতামহ, কে যুগের নীলকন্ঠ? সে-ই কি, যার হস্ত প্রাচীন যুগের শৃঙ্খল-দ্বারা বাঁধা থাকলেও যে সর্বান্তঃকরণে স্বাগত জানায় নবযুগদর্শীদের? যার হৃদয় তাদের কাছে বাঁধা থাকে? তবে সে ত আমি নই পিতামহ, সে যে আপনি। আর যদি যার হস্ত আবাহন করে ভূমিষ্ঠ করে নতুন যুগ ও শৃঙ্খলমুক্ত ধর্মকে— যে সেজন্য সহ্য করে ক্লেশ, যার তপস্যার প্রত্যক্ষ ফল সেই নতুন যুগ— সেও যে আমি নয়; সে অর্জুন। অর্জুনও ত আপনারই অংশ— যেমন দুর্যোধন?

ভীষ্ম— তুমি আমাকে অহেতুক কষ্ট দিচ্ছ, বার্ষ্ণেয়। কবে ত জরাকবলিত জগদ্দলদের নিজ হাতে তুমি মুক্তি দিতে পারতে শবদেহ-বহনের থেকে, কবেই ত প্রতিষ্ঠিত করতে পারতে ধর্মরাজ্য!

শ্রীকৃষ্ণ— ধর্ম এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না পিতামহ, ধর্ম মানুষের অন্তঃকরণে থাকে। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মের ক্ষেত্র, এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় কীর্তি ও উপসংহার— এভাবে প্রদর্শিত হয় উদাহরণ, উপলভ্য হয় ধর্মাচরণের সুযোগ ও মার্গ। মুক্ত হয় বন্ধন। হৃদয়কে স্মৃতি আর প্রভাবিত করে না, যা আপনাকে করে চলেছে সেই কবে থেকে। স্মৃতি, প্রতিজ্ঞা-রাক্ষসীর রূপ ধরে?

ভীষ্ম— তুমি সেই প্রক্রিয়ার সারথি, হে বার্ষ্ণেয়। তোমার রথ কার সাধ্য যে রোধ করে?

শ্রীকৃষ্ণ— আমি অর্জুনের সারথি। আমাকে চেনা এখনও আপনাদের বাকি আছে; আমার অতিমানবিক কোনও ক্ষমতা নেই, আমি নিজহস্তে সমাপন করতে পারি না সেই কার্য্য যার ভার সমগ্র মানবজাতির। তাদের সদিচ্ছা পরিকল্পনা আর কিচ্ছু না হোক্, রক্ত দিয়ে শোধ করতে হবে প্রাপণীয়র মূল্য। আমিও তার মধ্যে একটি জলের বিন্দু যে আপন গন্তব্যে বয়ে চলেছি। অস্ত্র আমার ধার্য্য নয়, কারণ আমি মানসিকভাবে এই সবের থেকে বাইরে। আমার নিজের কর্মের দায় যেদিন শেষ হবে, সেদিন আমাকে অরণ্যে বৃক্ষচ্ছায়ায় আত্মধ্যানে নিরুদ্দেশ দেখতে পাবে উত্তরপুরুষেরা।

ভীষ্ম— তুমি অস্ত্র না ধরলে আমি মরব না বাসুদেব। তোমার প্রতিজ্ঞা— তুমি নিরস্ত্র হয়ে শুধু অঙ্গুলিহেলনে, শুধু পূর্বগণনায় চালিত করবে সব। কিন্তু এই বৃদ্ধর শেষ আবদার তোমার কাছে, সারাজীবন যে নিজের জন্য কিছু চায় নি। আমাদের— পূর্বপুরুষদের— অপকীর্তির বোঝা তোমার পায়ের কাছে রাখলাম, হে উত্তরসুরী, হে বিচারক। সাথে রাখলাম এই ইচ্ছা। তোমার সাথে স্পর্ধা করতে লজ্জা নেই, শিশুপুত্র যেমন নির্বিচার (নির্বিকার) ভগ্নপ্রলাপে মহারথী পিতার সামনে স্পর্ধা প্রদর্শন করে।

শ্রীকৃষ্ণ— হে পিতামহ, পুর্বপুরুষেরা শুধু অপকীর্তি রেখে যায় না; ঐতিহ্যও রেখে যায়। ভারতবর্ষের লক্ষ্য হোক্ পূর্বপুরুষের কীর্তিকে ছাপিয়ে যাওয়া, পিতৃপিতামহদের গর্বিত করা। তা আমরা পারি নি, পারব না; সেই চরিত্রগঠন আমাদের হয় নি। কিন্তু আশা করব উত্তরপুরুষেরা পারবে। অভিমন্যু তার পিতার কীর্তিকে অতিক্রম করবে, তার পুত্র পরীক্ষিৎ পিতার নাম উজ্জ্বল করবে আশা করব। তখন আমরা কেউই থাকব না, আমাদের সবার কর্ম একত্রিত করে থাকবে চিরপূর্ণ চির-অপূর্ণ পরমাত্মা।
    পিতামহ, আমরা বড়ো পিতৃদ্রোহী, জানেন। আপনাকে আমরা কেবল আঘাতই করেছি, আপনাকে শিরোধার্য করি নি। সে ব্যর্থতা আমাদের, অর্জুনের। আমরা পুরাতনের সব ফেলে দিয়ে কি নতুন যুগে পা দিতে চলেছি? আমরা কি ভিক্ষুকের মত রিক্তহস্তে রিক্ত-অন্তঃকরণে নবনির্মিত যুগের দ্বারে উপনীত হব?
    না, পিতামহ, এখনও আপনার অনেক দায়িত্ব বাকী আছে। সে আপনিই পারবেন। মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রেখে আপনাকে যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যচালনার সমগ্র সুপরামর্শ দিতে হবে— যা আপনি কোনওদিন ব্যবহার করেননি। জানি, যুধিষ্ঠিরের জন্য অরণ্যবাসীর জীবনই শ্রেয়— তার দ্বারা এসব হবে না কোনওদিনই। কিন্তু লিপিবদ্ধ করবেন বেদব্যাস— শ্রবণ করবে উত্তরাধিকারীরা। আপনাকে ভুললে তাদের চলবে না।

ভীষ্ম— তুমি না বললেও আমি তাইই করতাম, মাধব। এখন তুমি বললে, কোনও পরিস্থিতিই আমার কাছে আর অসহনীয় মনে হবে না এই কার্যের জন্য। আমি যে জ্যেষ্ঠ, কুল-অভিভাবক। আমার ত দায়িত্ব আছে সেই সব সন্ততিদের প্রতি যারা এখনও জন্মায়নি।

শ্রীকৃষ্ণ— বিদায় আমি জানাই না, পিতামহ। এবার আজ্ঞা দিন।

ভীষ্ম— তোমার থেকে ত আমি বিচ্ছিন্ন হব না, বাসুদেব। এই শরশয্যারূপী জীবনে কে আছে তুমি আর মা গঙ্গা ছাড়া— যে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী? তোমার থেকে কে—ই বা বিচ্ছিন্ন? চল, আমরা দুজনে বিপক্ষে দাঁড়িয়ে এক পরমাত্মাকে সাধিত করি।

শ্রীকৃষ্ণ— এই যুদ্ধে আমরা অনেককে হারব, যাদের বিনিময়ে ধর্মের জয় আদৌ কাঙ্ক্ষিত কি না তাই নিয়ে আমার মনে এখনও আছে সংশয়। সংশয় থাকুক, একমুখী ধ্বংসাত্মকতা ভালো নয়; যুদ্ধক্ষেত্র কুয়াশাচ্ছন্ন হোক্ সংশয়ে, তাকে চিরে সূর্যের মত বেরিয়ে আসুক সত্য।
 
[ক্রমশঃ]

Comments

Popular Posts