কার নাম ফুলিয়ার মুখটী কৃত্তিবাস? প্রকরণ ১
কার নাম ফুলিয়ার মুখটী কৃত্তিবাস?
অনমিত্র বিশ্বাস
‘কী রে ভাই তুই কখন আসবি?’ অসীন ফোনে জিজ্ঞাসা করল। আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললুম, ‘ভাই, তিনটে ক্যাব মিনিট কয়েক করে অপেক্ষা করিয়ে ক্যান্সেল্ করে দিয়েছে, চতুর্থটাও বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না।’ ‘ক্যাব কি মেয়েরা চালাচ্ছে নাকি, যে পাত্তা দিচ্ছে না তোকে?’ বলে অসীন খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিল। আমি যখন যাদবপুর স্টেশনে পৌঁছলাম, তখন শীতের ভোর ৬টা আর অসীন শান্তিপুরের দুটো টিকিট কেটে ফেলেছে।
এইবার সেদিনের ব্যাপারটা গুছিয়ে বলা যাক। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতভাগ্যবিধাতার কী গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যাৎ-নির্ণয় সংঘটিত হয়েছিল— আর তা হয়েছিল এই বাংলায়, তার খবর আজকের ঢিলা-ফতুয়া ছেঁড়া জীন্স্ পরা বুদ্ধিজীবীরা রাখেন না। আফগানিস্থান আর ভারতের ভবিতব্য যে একমুখী হবে না সেটা সেইদিন ঠিক করে রেখেছিলেন একজন উষ্ণরক্তের বৈষ্ণব। আজ যেই মহাপ্রভুর নামে অর্ধেক ভারত কপালে হাত ঠেকায় তিনি তখন বাড়ির উঠানে হামাগুড়ি দিচ্ছেন, আর সেই পরমাদৃত শিশুর গতিবিধিতে নানা দৈব সুলক্ষণ প্রত্যক্ষ করে মা শচীদেবীর বুক বাৎসল্য গর্বে ও প্রফুল্লতায় ভরে উঠছে। তিনি তখনো বিপ্লব ঘোষণা করেননি, বরং জীবন তাঁর বড়ো বাঁধা গতে কেটে কেটে যাবে টোলে ছাত্র ঠেঙিয়ে সেইটারই সর্ব-সম্ভাব্য। ঠিক সেই সময়ে নিরুপায় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের এক ভাগ্যহত সারস্বতসাধক নিজের ঘরে বাধ্য হয়ে বসে রইলেন নিশ্চেষ্ট পতনের দর্শকরূপে; সেই মুহুর্তে সেই মধ্যবয়স্ক ব্যক্তির হাতে কেউ যদি বালক ক্ষুদিরামের মত অগ্নিকন্দুক এগিয়ে দিত, তিনি তারই প্রয়োগ করে ফেলতেন। তবে যেহেতু সেটা করে ওঠা হল না, তিনি সেই অসংযতভাবে গর্জে-ওঠা ‘সংহারিমু’র ক্ষুব্ধ আবেগকে এক পরিকল্পিত রাজনৈতিক বিপ্লবের গতিপথে বইয়ে দিলেন। তিনিই বৈষ্ণব আন্দোলনকে শূন্য থেকে গড়ে তুললেন গগনাস্ফালিত স্তম্ভের মত, নির্জীব নিসুপ্ত দেশের কোণায় কোণায় তর্জনে, ভাষণে, দর্শনে মানুষকে করে তুললেন উদ্দীপ্ত, অনাগত সংকটকালে না-মচকানোর জন্য তৈরী। কিন্তু যখন দেখলেন সেই শুভ যুদ্ধঘোষণার পটভূমি কংক্রীট দিয়ে নির্মিত, তখন নিজের তাঁর গুণ আর কর্মক্ষমতা তার চরম পর্যায়ে নেই আর। যে আন্দোলনকে তার দৈব পথে দুর্দৈব সময়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে যৌবনের যে অচিন্ত্য দ্বিধাহীন উদ্দীপনা লাগবে, প্রথমে আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও গতিপ্রকৃতি উপলব্ধি করতে এবং তার জন্য সকলকে আভাস-প্রস্তুতিতে যোগ্য করে তুলতেই সেই দুর্মদ যৌবন তাঁর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। ভিতের ওপর বাকি স্তম্ভটা গড়ে তোলার মত শক্তি বা পর্যাপ্ত আত্মবিশ্বাস কোনোটাই তাঁর আর নেই। সেই সময়ে যোগ্যতর এক তরুণের হাতে নিজের অসিকোষটি অর্পণ করে তিনি সরে দাঁড়ালেন লাইমলাইট হতে উত্তরাধিকারীর উজ্জ্বল উদ্দীপ্ত নবীন কান্তির ছায়ায়, ভক্তচক্ষু ও খ্যাতির অন্তরালে। বানপ্রস্থে নয়— নিজ-বোধ অনুযায়ী স্খলন, সিদ্ধান্তভ্রান্তি বা দ্বিধার সন্ধিকালে বহুবার তিনি সেই উত্তরপুরুষকে সতর্ক করেছেন পত্রযোগে বা মৌখিক বার্তায়। কিন্তু রাজমুকুটের বিড়ম্বনা তিনি আর বহন করেননি। বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষসে’র চাণক্য কতটা রোম্যাণ্টিসাইজ্ড্ আমি জানি না, কিন্তু অদ্বৈত আচার্যর মত এমন graceful অবসরগ্রহণ আমি ইতিহাস ঘেঁটে আর একজনকেই করতে দেখেছি, সিঙ্গাপুরের ‘ক্যাথে’ চলচ্চিত্র-প্রেক্ষাগৃহে যিনি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ভারতীর জাতীয় সৈন্যের সৈনাপত্যের তলোয়ার— রাসবিহারী বসু। তাঁর যুদ্ধশিবিরে নাম ছিল ‘সেন্সেই’, অদ্বৈতও ‘আচার্য’।
[ক্রমশঃ]
Copyright © 2022 Anamitro Biswas <anamitroappu@gmail.com>
Comments
Post a Comment