দুটো কথোপথন: একটা বাস্তবে, অন্যটাও অবাস্তব নয়
[This is a very informal draft of scribbling down a conversation with my friend Sairath, and assuming audaciously, from our loose lines of argument and Swamiji's volumes of work, how Swamiji would have reacted to the craze of liberal socialism. Opinions might vary, of course. Many factual points require rigorous referencing, which I have only sketchily done in brackets. Since only friends are reading this, hopefully the correctness will be believed; and I shall, when I get time, add more details in a separate reference list as is my academic habit, like archival numbers, book publishers and editions.]
গাড়ি চড়ে আসছিলাম ইস্ট মেট্রোপলিটান বাইপাস্ দিয়ে। তখন ইলেকশানের আগে, বন্ধুটি ঘোরতর কম্যুনিস্ট।
স্বৈরথ বললে, ‘আমাদের পার্টি নিয়ে তোর আপত্তিটা কোথায়?’ আমি বললুম, ‘আপত্তির আর কি আছে? তোরা তোদের মত চালিয়ে যা, আমি কি বারণ করেছি?’ সে বলল, ‘তবে —কে ভোট দিবি না কেন?’ এ-প্রশ্নটা কম্যনিস্টরা করেই থাকে। অন্য পার্টির সদস্যরা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, বোঝানোর চেষ্টা করে, কী কারণে তাদের ভোট দিলে দেশের দশের উপকার হবে। কম্যুনিস্টরা ধরে নেয় বাই ডিফল্ট সব ভোট তাদেরই প্রাপ্য। কারণ তারা ইন্তেলেকচ্যুয়াল্, তাদের বয়ানে ক্যুবা-বলিভিয়া-জার্মানি-রুশমুল্লুকের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। সে যাই হোক্, আমি এসব আলোচনায় সচরাচর যাই না; কিন্তু সেদিন হঠাৎ চোখে পড়ল পথের ধারে স্বামী বিবেকানন্দের একটা মূর্তি। আমি বললাম, ‘তোদের শতরূপদা এই মূর্তির গলায় পাব্লিকলি মালা দেবে? না, লেনিনের মূর্তির গলায় দেয় তা আমি দেখেছি।’ সে বলল, ‘না, তা কেমন করে হবে?’ আমি বললাম, ‘যে দেবে না, আমি তাকে ভারতের উত্থানের পথে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি না। ভারতের সুপ্রাচীন সভ্যতার সে কেবল ক্ষতিই করতে পারে।’ বন্ধুটি বলল, ‘এই তোরা বিজেপি-সাপোর্টাররা সবটাকেই কেবল ধর্মের দিক থেকে দেখিস্।’ আসলে তাদের দলে না হলেই তারা বিজেপি বানিয়ে দেবে। আমি বললুম, ‘তাতেই বা ক্ষতি কি? আমার বিচারের একটি মানদণ্ড যদি ধর্মবোধই হয়? বিজেপিও তো পার্লিয়ামেণ্টারি ডিমোক্র্যাসির অঙ্গ। তারও তো সপক্ষে যুক্তি দাখিল করবার— এবং একজন নাগরিকের তাতে কনভিন্সড্ হবার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। কিন্তু সে-প্রসঙ্গে যাচ্ছি না, আমি তাও বলছি না। যুগনায়ক বিবেকানন্দ। ভারতীর রেনেসাঁর প্রাণপুরুষ বিবেকানন্দ। মানবদরদী বিবেকানন্দ। কলকাতার প্লেগের সময়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া নিবেদিতা-বিবেকানন্দ? তিনি গেরুয়া পরতেন আর নেহাৎ ভাগ্যের ফেরে লেনিনগ্রাদের জন্মগ্রহণ করেননি বলে তোদের শতরূপ-দা তাঁর গলায় মালা পরাবেন না?তবে ত তোরা বিদেশের আমদানি সংস্কৃতির উপনিবেশস্থাপক রে!’
স্বৈরথ বললে, ‘আমাদের পার্টি নিয়ে তোর আপত্তিটা কোথায়?’ আমি বললুম, ‘আপত্তির আর কি আছে? তোরা তোদের মত চালিয়ে যা, আমি কি বারণ করেছি?’ সে বলল, ‘তবে —কে ভোট দিবি না কেন?’ এ-প্রশ্নটা কম্যনিস্টরা করেই থাকে। অন্য পার্টির সদস্যরা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, বোঝানোর চেষ্টা করে, কী কারণে তাদের ভোট দিলে দেশের দশের উপকার হবে। কম্যুনিস্টরা ধরে নেয় বাই ডিফল্ট সব ভোট তাদেরই প্রাপ্য। কারণ তারা ইন্তেলেকচ্যুয়াল্, তাদের বয়ানে ক্যুবা-বলিভিয়া-জার্মানি-রুশমুল্লুকের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। সে যাই হোক্, আমি এসব আলোচনায় সচরাচর যাই না; কিন্তু সেদিন হঠাৎ চোখে পড়ল পথের ধারে স্বামী বিবেকানন্দের একটা মূর্তি। আমি বললাম, ‘তোদের শতরূপদা এই মূর্তির গলায় পাব্লিকলি মালা দেবে? না, লেনিনের মূর্তির গলায় দেয় তা আমি দেখেছি।’ সে বলল, ‘না, তা কেমন করে হবে?’ আমি বললাম, ‘যে দেবে না, আমি তাকে ভারতের উত্থানের পথে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি না। ভারতের সুপ্রাচীন সভ্যতার সে কেবল ক্ষতিই করতে পারে।’ বন্ধুটি বলল, ‘এই তোরা বিজেপি-সাপোর্টাররা সবটাকেই কেবল ধর্মের দিক থেকে দেখিস্।’ আসলে তাদের দলে না হলেই তারা বিজেপি বানিয়ে দেবে। আমি বললুম, ‘তাতেই বা ক্ষতি কি? আমার বিচারের একটি মানদণ্ড যদি ধর্মবোধই হয়? বিজেপিও তো পার্লিয়ামেণ্টারি ডিমোক্র্যাসির অঙ্গ। তারও তো সপক্ষে যুক্তি দাখিল করবার— এবং একজন নাগরিকের তাতে কনভিন্সড্ হবার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। কিন্তু সে-প্রসঙ্গে যাচ্ছি না, আমি তাও বলছি না। যুগনায়ক বিবেকানন্দ। ভারতীর রেনেসাঁর প্রাণপুরুষ বিবেকানন্দ। মানবদরদী বিবেকানন্দ। কলকাতার প্লেগের সময়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া নিবেদিতা-বিবেকানন্দ? তিনি গেরুয়া পরতেন আর নেহাৎ ভাগ্যের ফেরে লেনিনগ্রাদের জন্মগ্রহণ করেননি বলে তোদের শতরূপ-দা তাঁর গলায় মালা পরাবেন না?তবে ত তোরা বিদেশের আমদানি সংস্কৃতির উপনিবেশস্থাপক রে!’
বাড়ি ফিরে নৈশাহার সেরে ঘরে কোনও একটা বইয়ের পাতা উলটাচ্ছিলাম, এমন সময়ে এক দিব্যকান্তি পুরুষ দরজায় এসে দাঁড়ালেন। কালো কোট তাঁর গায়ে শার্লকের চেয়েও ভালো মানিয়েছে। গভীর অন্তর্ভেদী কালো চোখ আর ঢেউ-খেলানো চুল দেখে তাঁকে চিনতে কষ্ট হবার কথা নয়। কিন্তু আমি এক-ধাক্কায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ‘হ্যাঁ রে, আমায় নিয়ে অমন খণ্ডযুদ্ধ বাধিয়ে দিলি কেন রে বন্ধুর সাথে?’
আমি বললুম, ‘আপনি?’
তিনি বললেন, ‘সে কী? আমার অত সুখ্যাতি করলি, আর আমায় চিনলি নে?’
আমি সংবিৎ ফেরৎ পেয়ে বললাম, ‘আপনাকে না চিনলে আমার জীবন বৃথা।’ বলে পায়ের ধুলা নিলাম। তিনিও মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। মনে হল, এই তরে গেলাম ভবনদী। আবার বললেন, ‘এ-সব তত্ত্বকথায় তোর দরকার কী? বন্ধুর সাথে ঝগড়া বাধাস্ কেন?’
আমি বললাম, ‘ও যে বোকার মত কথা বলছিল। খালি এঁড়ে-তক্কো করে যাচ্ছিল।’
তিনি বললেন, ‘করছিল ত করছিল। কে কী বলল তাতে আমাদের কি আসে যায়। তুই তোর নিজের মত কাজ করে যা দিকিনি। আর অমনি কি বিবাদ বাধাতে আমি এসেছি রে। বন্ধুত্বটাই পৃথিবীতে আজ সবচেয়ে বেশী দরকার রে বাপ। আমিও কি পারতুম না রামকৃষ্ণ সম্প্রদায়ের মঠ তৈরী করতে? কিন্তু এ-কথা ভাবলেই মনে হয়, তা করতে ত আমরা আসিনি। সবার মধ্যে মিলন ঘটানোর জন্যই আমার গুরু,’ তিনি কপালে হাত জোড় করে ঠেকালেন, ‘ধরাধামে এসেছিলেন। নইলে তাঁর ভারী বয়ে গেছে এই জঞ্জালের মধ্যে ষাটটি বৎসর কাটিয়ে যেতে। সত্যযুগ এসে গেছে (বেলুড় মঠের আদি নিয়মাবলী দ্রষ্টব্য)। তোরা আর বিবাদ করবি না। শুধু সত্যকে আঁকড়ে থাকবি নিজের মধ্যে। খুব জোর দিয়ে আঁকড়ে থাকবি। ও যদি ওর— কী বেশ নাম বললি?’ আমি বললুম, ‘কম্যুনিজম্।’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, সে-ধর্ম আঁকড়ে ধরে সুখী থাকে, তাতে তোর আপত্তি কী? তবে হ্যাঁ— তাতে কারও ক্ষতি না হয়।’
স্বামীজী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কম্যুনিজম্ কী জিনিস?’ সত্যিই ত, ও জিনিসটির হাইপ ত আর তিনি দেখে যান্নি। আমি তাঁকে বুঝিয়ে বলতে তিনি বললেন, ‘তবে সেই ত, পুরোটাকেই বস্তুবাদ অর্থাৎ মেটিরিয়ালিজমের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা। সে আমার বড়ো ভালগার লাগে।’ আমি বললাম, ‘না না মহারাজ, বস্তুবাদের বিরুদ্ধেই ত তাদের সংগ্রাম।’ তিনি বললেন, ‘সে কেমন? কী বললি কথাটা— প্রলেতারিয়া, হ্যাঁ, এই প্রলেতারিয়াদের মধ্যে যে সভ্যতা নেই, সংস্কার নেই, নেই ধর্ম নেই শিক্ষা নেই জ্ঞান— সে কী তারা ভাবছে? শুধু বলেছে, টাকা নেই তাদের। মানে হাতে হাতে টাকা ঢেলে দাও— সে টাকা দিয়ে তারা দ্বিগুণিত মদ গিলুক। অমনি সাম্য আসে না রে বাপ। আমেরিকায় আমি দেখেছি অভিজাত মেমসাহেবদের— তাদের রুজের পিছনে খরচা-টুকুও তোর কল্পনার বাইরে। কিন্তু কী আছে তাদের? সেই টাকা দিয়ে তারা কী করেছে? কিটি-পার্টি! অস্বাস্থ্যকর সুস্বাদু খাবার আর মদ খেয়ে স্বাস্থ্যের বারোটা বাজিয়েছে। এইই কি পরিণাম? উপরন্তু আমি দেখেছি, ভারত ছাড়া কোন্ দেশে আর সম্ভব— তিনখানা মাটির ঢিবি আর খানকতক কাঠ নিয়ে এদেশের রাঁধুনী যে সুস্বাদু অন্নব্যঞ্জন তৈরী করে? একখানা ছেঁড়া মাদুর, একটা মাটির প্রদীপ, তায় রেডির তেল, এই উপাদান-সহায়ে দিগ্গজ পণ্ডিত যে হয়? (বাণী ও রচনা অষ্টম খণ্ড, ৫১৮তম চিঠি) বিদ্যাসাগর-মশাইকে দেখিসনি তোরা, আমি দেখেছি। ওরে শতজন্ম তপস্যা করে ওরকম একটি পরিপূর্ণ মানুষ বানাক্ দেখি আমেরিকা।’
আমি গতিক দেখে বললাম, ‘সাধে কি আমি ওর সাথে তর্ক করি?’
স্বামীজী একটু গম্ভীর হলেন; বললেন, ‘কী বল্ ত, এতে লাভ হবে না। আমিও আমেরিকায় গিয়ে আমার গুরুর নাম নিই নি কোনও বক্তৃতায়। পরে আমার কাছে এসে যারা আমার কথা শুনতে চাইত, তাদের মধ্যে যারা উৎসাহ দেখাত শুধু তাদেরই বলেছি। সবাই তাদের অবতার নিয়ে মেতে আছে। কেউ মহম্মদ ত কেউ— কী বললি নামটা? মার্কস্ (স্বামি-শিষ্য সংবাদ ও বিভিন্ন চিঠিপত্র দ্রষ্টব্য)। তুই তোর কাজ চালিয়ে যা। তোর জীবনযাপনে যেন ত্রুটি না থাকে। ব্যাস্, তাইতেই দেখবি যার শেখার সে ঠিক শিখে যাবে। ওতেই দেখবি অনেক হবে।
আমি কিছুক্ষণ পরে বললাম, ‘আপনি এই কথা বললেন, অথচ কবীর সুমন (পুরনো ফেসবুক পোস্ট, ছবি তুলে রাখিনি) এবং তাঁর দেখাদেখি লোকজন যখন আপনাকে হিন্দুত্ববাদী বলে, তখন কী নিদারুণ মিথ্যা কথা বলা হয়। রাগে আমার গা জ্বলে যায়!’ তিনি বললেন, ‘কবীর সুমনটা আবার কে? আর একে ত ‘হিন্দু’ একটা ফার্সী ভুল উচ্চারণ, ভুল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়— তার মধ্যে একটা শুদ্ধ সংস্কৃত ত-এ ব লাগালি কোন্ আক্কেলে?’ (হিন্দুধর্মের নবজাগরণ প্রসঙ্গে দাক্ষিণাত্যে প্রদত্ত বক্তৃতা) আমি বিষণ্ণসুরে বললাম, ‘আজকাল সবাই তাইই বলে। আপনি যে-দেশে ছিলেন, সেখানে রাজা হিন্দু-হিন্দুবিরোধী কিছুই ছিল না। রাজা ছিল খৃষ্টান, কিন্তু প্রজার ধর্ম নিয়ে তার কিঞ্চিৎ মাথাব্যথা ছিল না। তার মাথাব্যথা ছিল প্রজার ধনসম্পদ নিয়ে। তখন জাতের নামে বজ্জাতি করলে লোকে শাস্তি পেত; আজ দেশে কোনও ধর্ম নেই— অর্থাৎ বেদান্তধর্ম অস্বীকৃত রাষ্ট্রদ্বারা। সদ্ধর্ম না থাকলে যার গায়ের জোর বেশী, সেইই আস্কারা পায়। ভারতেও তাইই হয়েছে। যেখানে যা-কিছু হোক্, একদল স্বঘোষিত ‘লিবেরাল’ আছে— সব দোষ তাদের বেদান্তধর্মের ওপরই চাপানো চাই। বেদান্ত বানান জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে, ‘ভি-ঈ-ডি-এ-এন্-টি-এ’! আপনাকে নিয়ে এখন গেরুয়া-যুবমোর্চার ভাগাভাগি চলছে। আজকের ইয়ুথ-আইকনরা ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইয়ুথ-আইকনের গলায় মালা দিতে লজ্জা পায়!’
স্বামীজী হাসলেন; বললেন, ‘আমায় অত মাথায় তুলিস্ নি। বরং আমার কাজটাকে এগিয়ে দে ত বাপ। আমার নাম না করলে তাতে কি আর আসে যায়? আমার idea নিলেই হল— নিন্দন্তুনীতিনিপুণাঃযদিবাস্তুবন্তু। (স্বামী-শিষ্য সংবাদ, ৩৮) আমার মাতৃভূমির একটুকু কাজে লাগতে পারলে তার বিনিময়ে আমি সহস্রজন্ম নরকবাস করতে রাজী— সে-কথা ত কতবার বলেছি।’
আমি বললাম, ‘আমাদের আপনি ছাড়া বড় একটা গতি আছে কী? তাই আপনার গায়ে কাদা ছিটাতে দেখলে খারাপ লাগে। জানি, গেরুয়ার রঙ কাদা লাগলে কিছুই নষ্ট হয় না; কিন্তু আমার খারাপ লাগে। যখন দেখি ইলেকশানের আগে আপনাকে গালমন্দ করে কিছু নষ্টবুদ্ধি আব্বাস সিদ্দিকির মত একটি নরাধমকে জাস্টিফাই করছে। আপনি নাকি বলেছিলেন, কেউ হিন্দুধর্ম ত্যাগ করলে যে হিন্দুধর্মের একটি সদস্য কমে যায় তাইই নয়, একটি শত্রুও বেড়ে যায়। (বেলুড় মঠের আদি নিয়মাবলী) এ মূর্খেরা আপনার বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণীর কণামাত্র পড়ল না, জানল না; কেবল এইটা নিয়ে বারেবারে আপনার বেদান্তধর্মের প্রতি আঘাত করতে লাগল। সে-মূর্খ বুঝল না, যে এই ভেদভাব পৃথিবীর সব ধর্মেই আছে, কিন্তু বেদান্তধর্ম তবু অবিশ্বাসীকে হত্যা করতে করতে বলে না ফ-ইধা ইন্সলাখা ল্-আশ্হুরু ল্-হুরুমুু ফা-উক’তুুলূূ ল্-মুুশ্’রিকীনা হয়থু ওয়াজাদ্ত্তুমুহুম্ ওয়াখুধূহুম্ ওয়া-হু’সুরূহুম্-এর মতো।’
স্বামীজী সাথে সাথেই বললেন, ‘কেন, ভুল কি বলে? যে ধর্মত্যাগ করে সে বেদান্তধর্মের শত্রু নয় ত কী?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘তবে? আপনি যে বলেছিলেন বেদান্ত মানুষে মানুষে কেবল মিল ঘটাবে, সে-কাজেই আপনার জীবনের ব্রত? আপনি যে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী শুনিয়েছেন— আমেরিকার অগণিত বিজাতীয় নরনারীকে ভগ্নী-ভ্রাতা বলে আপন করে নিয়েছেন, আপনাকে ত আমি সেই মহামিলনের সংঘটক বলে জানি। আপনার মুখে এ আবার কী স্ববিরোধী কথা।’ স্বামীজী একটু যেন ভেবে নিলেন সহজ করে কথাটা আমাকে কী করে বুঝিয়ে দেবেন। যিনি আস্ত বই শুধু একবার পাতা উল্টে পড়ে নিতে পারেন, তাঁর মত করে আবলীলায় ভারী ভারী তত্ত্ব বুঝে ফেলার ক্ষমতা যে আমার নেই, তা তিনিও জানেন। আমাকে ধাপে ধাপে বুঝিয়ে দিতে হবে। তিনি বললেন, ‘ধর্, তোর সাথে তোর পাড়ার অন্য সব বাড়ির ছেলেদের সৌহার্দ্য থাকবে, এটাই তো উচিত। কিন্তু তোর নিজের ভাই যদি তোদের থেকে ভিন্ন হয়ে, বাপ-মা-ভাই-বোন ছেড়ে অন্য বাড়িতে চলে যায়, সেটা কি খুব সমর্থনযোগ্য কাজ? না তাকে ক্ষমা করা উচিত? বড় গাছ অন্য লতা-গুল্মকে আঁকড়ে ধরে, জড়িয়ে রেখে আশ্রয় দেয়, কিন্তু নিজের একটি ডাল ভেঙে গেলে আর শত-প্রচেষ্টাতেও জোড়া লাগে না; বেদান্তধর্ম হচ্ছে সেই মহীরূহ। কী, এবার বুঝলি?’ রবীন্দ্রনাথও এরকমই একটা কী লিখেছিলেন না? গোরা আর বিনয়ের কথোপকথন ছিল।
স্বামীজী বললেন, ‘আর কথাটা ত ভুল নয়, ইতিহাস তার প্রমাণ আছে। কালাপাহাড়ের গল্প শুনিস্ নি তোরা? নাকি স্কুলের বইতে ওসব অপ্রিয় প্রসঙ্গ বাদ পড়ে যায়?’ আমি বললাম, ‘শুনেছি, ভাসা-ভাসা। পড়িনি— ঠিকই ধরেছেন আপনি।’ ‘অমন উদাহরণ সহস্র পাবি,’ স্বামীজী বললেন, ‘আমাদের দেশের যা শিল্প-সাহিত্য— আর তার আকর মন্দির ও শাস্ত্র— তোরা দেখছিস্, তার কয়েক গুণ নষ্ট করেছে তুর্ক পাঠান আর মুঘলেরা, আর তাদের দিশি চ্যালারা। কালাপাহাড়ের মত যারা নিজের শিকড়কেই মুলোচ্ছেদ করার সংকল্প করেছিল। ভারত ছাড়া আর কোন দেশে কটা টাকার জন্য ভাই ভাইয়ের গলা কাটতে পারে?’ (চিঠিপত্র দ্রষ্টব্য) আমি বললাম, ‘জানি। এ-কথা আপনি ভগ্নী নিবেদিতাকে চিঠিতেও লিখেছিলেন।’ একটু পরে বললাম, ‘তাইই যদি জানেন, স্বামীজী, তবে ‘পরিব্রাজক’-এ কেন খামোকা খৃষ্টান পাদ্রীদেরই গালমন্দ করতে গেলেন? ভারতবর্ষের যদি কোনও আততায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে হয়, তবে সে ত খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে নয়।’ মনে মনে বললাম, ‘ভাবতে ভালো লাগছে, বিবেকানন্দ, তুমিও মানুষ। শিকাগোর দুর্বহ দিনগুলোতে প্রেসবাইটেরিয়ান্দের দ্বারা নিগ্রহের ব্যক্তিগত ক্ষোভ তুমি ভুলতে পার নি।’ স্বামীজী খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপরে কপালে আঙুল বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘আমি ও-লেখাটা লিখতে চাই নি। আমি ত্রিগুণাতীতকে বলেছিলাম, লঘুরসাত্মক ভ্রমণকাহিনীতে সব কথা বলা যায় না। বিদেশের পটভূমিকায় ঐ অভিযোগগুলো না করলে ভারতবর্ষের গৌরব কেন তলানিতে এসে ঠেকেছে আর কীভাবেই বা তার পুনরুদ্ধার সম্ভব— সে-কথা বোঝান যাবে না। শুধু আজ বলে নয় রে— বর্বরদের ঔদ্ধত্য দেশে চিরকালই ছিল। আমাদের সময় ত হিন্দুস্থানী ভাষাও মধ্যপ্রাচ্যের নস্তলিক্ হরফে লেখা হত। আমাকে তারই মধ্যে পত্রিকা আর সংগঠন দুইই চালাতে হত। আমি ওদের বলেছিলাম, দিনলিপি লিখলে কেউ পড়বে না, রসের কথা কাব্যিকতা আমার আসে না, আর বাকি যে পন্থাটা তার ছিদ্র তুই ধরে ফেলেছিস্।’
আলাপের পালা শেষ হয়ে এল; আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আবার কবে দর্শন পাব মহারাজ?’ তিনি হাতের ভঙ্গিতে প্রশ্নটাকে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘সে তুই চাইলেই দেখা হয়। আমার দোর ত সবসময় খোলা রে; জিজ্ঞেস করে দেখিস্ ত, বোষ্টম হোক্ কি মুয়াজ্জেম, বেলুড় মঠে এসে কখনও ফিরে গেছে কি না।’ তিনি দরজার দিকে এগোবার সময় ক্রোড়োপযন্ত্রে খোলা ‘বাণী ও রচনা’-র পাতার ওপর দৃশ্যপটে তর্জনী দিয়ে একটা টোকা মেরে গেলেন; বললেন, ‘বেড়ে ছেপেছে রাখাল।’
বাণী ও রচনা থেকে চোখ তুলে দেখি দরজা বন্ধ আবার। বাইরে ঝড় থেমে গিয়েছে। যেন ঝড়ের মত এলেন আবার ঝড়ের মতই চলে গেলেন স্বামীজী, মধ্যিখানে আমার অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর দিয়ে। হাজার-টা পরাধীনতার বছর ধরে ভারতবর্ষ যে সব প্রশ্ন নিয়ে অন্ধযুগের অন্ধকারে হাতড়ে বেরিয়েছে আর হোঁচট খেয়েছে। এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর যে বাকী আছে। কে দেবে সেই উত্তর? নেতাজীর ছবির সামনে দাঁড়ালে রবিঠাকুরের একটা পদ্য মনে পড়ে, ‘তোমার শঙ্খ ধুলার পড়ে, কেমন করে সইব?’ তুমি সইতে পার হেলায়, উপেক্ষা করতে পার অকিঞ্চিৎকর-জ্ঞানে, কিন্তু আমি কেমন করে সইব? স্বামীজীর শঙ্খ যাঁরা তুলে নিয়েছেন তাঁরা বাজাতে পারেননি তত অবলীলায়। ভক্ত-শিরোমণি সুভাষচন্দ্র বসু ‘ভারত-পথিক’-এ তা নিয়ে বিরক্তিও প্রকাশ করেছেন একবার। একবার আমার এক দাদার কাছে (তিনি এখন শিলচর রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের একজন নবীন সদস্য) এটা বলেছিলাম হতাশার সুরে। বলেছিলাম, ‘স্বামীজীর উত্তরাধিকার কি সত্যিই মননে বইতে দেখেছি রামকৃষ্ণ মিশনে? ভারতবিধাতার ইতিহাসের বিভিন্ন নির্ণায়ক সন্ধিক্ষণে তন্নতন্ন করে খুঁজেও রামকৃষ্ণ মিশনের তেমন দৃঢ় ভূমিকা ত কোথাও দেখি না, ১৮৯৮-এর প্লেগের সময়ের যেমনটা ছিল অথবা ভারতীয় রেনেসাঁর প্রথম পর্বে।’ দাদা বললেন, ‘তুই বল্ ত, যা তুই এত সহজে বললি, কথাটা কি আসলে এতই সহজ? বিবেকানন্দ কটা জন্মায়, তাও এমনি অপ্রতিদানের দেশে? বিবেকানন্দর দার্ঢ্য ও প্রজ্ঞা আর কেউ কী করে প্রকাশ করবে, হলই বা সে সন্ন্যাসী?’
এটা সত্যি। নাই সেই দার্ঢ্য, সেই প্রজ্ঞা। নাই সেই ক্ষমতা, নাই সেই অসম সাহস ও ভক্তি। আমাদের বকরির কলিজা, পাষাণের হৃদয়। আমার চক্ষে লালসা, কণ্ঠে ছলনা। তবু কখনও কখনও আরশি-নগর খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঠোঁটে লিপ-বাম্ লাগানোর সময়ে, বা গালের ওপর ট্রিমার চালাতে চালাতে। তখন কদাচিৎ বা নিজের চোখে নিজের ছায়া দেখে মেলাতে পারি না— মায়ের কোলে শুয়ে ছোট্টোবেলার আধো-ঘুমে যে-মানুষটা হতে চেয়েছিলাম, তার সাথে। কখনও কোনও একটা সাহসী ভালো কাজ করে ফেলেছিলাম বা, সেটা মনে পড়ে। কেন বাকী বায়ো-ডেটাটা এমন ছন্নছাড়া ধূসর হয়ে গেল, সেই চিন্তা গেঁথে বসে মনে। তখন আয়নায় আরেকটা মানুষকে দেখতে পাই। তিনি হেসে বলেন, ‘লেগে পড়্। আমি তোদের যেমন ভালোবাসি, তোরাও তেমনি করে ভালোবাস্ দিকিনি। মানবতাকে ভালোবাস্, ঈশ্বরকে ভালোবাস্। অমৃতের সন্তান তোরা, তোদের আবার ভয় কী?’
Comments
Post a Comment